Site icon অপরাজিতা

আমার জীবনের গল্প

আমার জীবনের গল্প

 

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় আমার। বাবা শশুরের সাথে আগেই কথা বলে নিয়েছিলেন- মেয়ে আর পড়াশোনা করতে পারবে না। তারা বনেদি পরিবারের মানুষ। বউয়ের রোজগারে দিন পার করতে হবে না। ছেলের বউ ঘরকন্না সামলাবে, পোলাপান মানুষ করবে। মেয়েদের পা বাইরে গেলে তাদের শেকল কে’টে যায়। তখনও ভালো করে সংসার জ্ঞান আসেনি। অতশত বুঝতাম না। মা এই বিয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে বাবা তার কথা শোনেননি। ছেলে ভালো, পড়াশোনা শেষ করেই সরকারি চাকরি পেয়ে গেছে। বিশ কাঠার ওপর বিশাল বাড়ি। বছরের চাল ঘরে তোলা থাকে। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি!

বিয়ের দিন সকালেও বই নিয়ে বসেছি। মা এসে বই কেঁড়ে নিতে নিতে বললেন, “এখন থেকে এসব চিন্তা মাথায় আনবি না। মন দিয়ে সংসার করবি। ও বাড়ি থেকে যেন কোন নালিশ না শুনি।”
পরক্ষণেই মা সুর বদলে ফেললেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “মেয়েদের বেশি পড়াশোনা ভালো না মা। ঘর সংসার আসল। আমরা তোর ভালো চাই।”

কিছু বলিনি। ভয়ে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছি। বিয়ের আলোকসজ্জা, লোকের সমাগম, কোন কিছুই আমার ভয় কাটাতে পারেনি। এখনও মনে পড়ে সে রাতে খুব বৃষ্টি পড়ছিল। চারদিকে ভিজে গন্ধ, কাঁদা মাটি, বাচ্চাদের চিৎকার সবকিছু মিলিয়ে খারাপ অবস্থা। দাদি শাশুড়ি বললেন, “বউয়ের কপাল ভালো। শুভ কাজে বৃষ্টি হওয়া রহমতের লক্ষন। মানিক খুব সৌভাগ্যবান।”

বাসর রাতে মানুষটার সাথে প্রথম দেখা। ছিপছিপে লম্বা শরীর, মেয়েদের মতো বড় বড় চোখ, কোমল কন্ঠস্বর। কাকা ভেজা হয়ে ঘরে ঢুকেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় পড়ে গেলেন। বিব্রত গলায় বললেন, “কয়েকজন বন্ধু এসেছিল। ওদের আবার ফেরত যেতে হবে। এগিয়ে দিয়ে এই অবস্থা হয়েছে।”

কথাগুলো বলেই তোয়ালে হাতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আমার ভয় তখনও কাটেনি। কিছুক্ষণ আগে বয়স্ক এক মহিলা এসেছিলেন। তিনি হঠাৎই আমার গায়ে হাত দিয়েন। কুৎসিত গলায় বললেন, “আমার ছোঁয়ার এমন হলে, বরের ছোঁয়ায় কি করবে মেয়ে? তবে আর যা-ই করো না কেন, স্বামীকে বাঁধা দেবে না। চিৎকার করবে না।”

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “তিনি কি আমায় মা’র’বে’ন?”

জবাবে কিছু কিছু বলেননি। দাঁত চিবিয়ে হেসেছেন। হাসি দেখে রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। দরজা খোলার শব্দে কেঁপে উঠলাম। বুকের ওপর থুথু ছিটিয়ে দম খিঁচে রইলাম। উনি খুব হাসলেন। খাটের ওপর বসতে বসতে বললেন, “ভয় পেয়ে গেলে নাকি?”

ভীতু চোখে তাকালাম। তিনি অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “দুঃখিত। আমার একটু সাবধান হবার দরকার ছিল। বর্ষাকালে কাঠের দরজা ফুলে গেছে। জোর হাতে না খুললে বাথরুমের দরজা খোলে না।”

জবাবে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। সবাই উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে বলেছিল। তবে আমার ভীষণ লজ্জা করছে। মানিক সাহেব সরু চোখে তাকালেন। সহজ গলায় বললেন, “ শাড়ি গহনা পরে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে? অসুবিধা হলে কাপড় বদলে নাও। বাথরুমে গিয়ে ওজু করে এসো।”

উঠলাম তবে বহু কষ্টে। পা যেন সীসার মতো জমে আছে। ব্যাগ থেকে থ্রি-পিস বের করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। উনি উঠে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আবারও বিছানায় বসে পড়লেন। কাপড় বদলে ওজু করে নিলাম। ভয় খানিকটা কেটেছে, তবে পুরোপুরি না। বাইরে আসতে দেখি উনি পাঞ্জাবি পরে আছেন, জায়নামাজ বিছিয়ে রেখেছেন। আমায় দেখে কোমল গলায় বললেন, “তুমি নামাজ পড়তে পারো?”

হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালাম। উনি বললেন, “এসো, আমার পেছনে দাঁড়াও।”

দু’জনে মিলে নামাজ শেষ করলাম। উনি খানিকক্ষণ সূরা-কালাম পড়ে মাথায় ফু দিয়ে দিলেন। বাতি নিভিয়ে দিয়ে বললেন, “অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়। রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে।”

ঘুমিয়ে পড়ার আগমুহূর্তে সব ভয় কেটে গেল। মনে হলো উনি খুব ভালো মানুষ। পরেরদিন ঘুম ভাঙলো বেলায়। চারদিকে আলো ফুটে গেছে। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় বসলাম। চারদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলাম। নাহ! মানিক সাহেব ঘরে নেই। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে চলে এলাম। বাইরে আসতেই খেয়াল করলাম সকলে কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শাশুড়ি মা কড়া গলায় বললেন, “এই মেয়ে তুমি থ্রি-পিস পরেছ কেন? এই বাড়ির বউয়েরা সবসময় শাড়ি পরে। কার কথায় এই পোশাক পরেছ?”

নিচু গলায় বললাম, “উনার কথায়।”

“উনি আবার কে? কার এত সাহস?”

হাত উঁচু করে ঘরের দিকে দেখালাম। দাদি শাশুড়ি হো হো করে হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, “উনি মানে বুঝতে পারছ না বউ মা? তোমার ছেলে বলেছে।”

শাশুড়ি মা চোখ-মুখ শক্ত করে ফেললেন। বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজ করতে লাগলেন। দাদি শাশুড়ি বললেন, “এই যে নাতবৌ, শুধু কি রূপই আছে নাকি কাজকর্ম কিছু জানো?”

বাড়িতে তেমন কাজ করা হয়নি। মা কখনও কাজ করতে বলতেন না। তবে উনার মুখের ভাব দেখে সত্যি কথা বলতে পারলাম না। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললাম। তিনি বললেন, “বেশ ভালো। তবে তো তোমার রান্নার পরীক্ষা নিতেই হচ্ছে। বউ মা, ওকে পায়েসের জিনিসপত্র দেখিয়ে দাও। আমার জন্য পায়েস রান্না করুক। বুঝলে নাতবৌ, কিসমিস আর বাদাম বেশি করে দেবে। মানিক পছন্দ করে।”

উনার নাম শুনে কেমন একটা কেঁপে উঠলাম। দাদি শাশুড়ি গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। শাশুড়ি মা সকালের রান্না শেষ করে পায়েসের জিনিসপত্র দেখিয়ে দিলেন। চুলার পাশে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছি। পায়েস রান্নার পদ্ধতি অজানা না। মা’কে অনেকবার রান্না করতে দেখেছি। তবুও কেমন ভয় লাগছে। লম্বা শ্বাস নিয়ে চুলায় পাতিল বসলাম। হঠাৎই এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, “তুমি বসো। আমি রান্না করে দিচ্ছি।”

“উনি যে বললেন আমাকে রান্না করতে হবে। মা বলেছে এ বাড়ির সবার কথা মেনে চলতে।”

“মেনে ত চলবেই। তবে এত বড় হাঁড়ি উঁচু করতে গেলে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তখন? বাচ্চাদের আগুনে পাশে আসতে নেই। কখন কি হয়! তার থেকে ভালো, তুমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দাও। কেউ আসলে আমায় বলবে।”

অমত করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম। উনি রান্না করে দিয়ে চলে গেলেন। সারাদিন বেশ ভালোই কাটলো। এ বাড়িতে আমার বয়সী দু’জন মেয়ে আছে। ওদের সাথে বসে বসে গল্প করলাম। দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। সম্পর্কে মানিক সাহেবের মামাতো বোন। সমস্যা শুরু হলো রাতে, দাদি শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। শশুর আব্বু রাতে খেলেন না। শাশুড়ি মা কয়েকবার চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। শোবার সময় মানিক সাহেবের কাছে প্রশ্ন করলাম, “দাদিমা চলে গেলেন কেন?”

“এসব ব্যাপারে তোমায় ভাবতে হবে না। আর কেউ কিছু বললেই মা দুলিয়ে হ্যাঁ বলতে যাবে না। নিজের ক্ষতি হবে কি-না বিবেচনা করে দেখবে।”

উনার গলার স্বর এতটাই কঠিন ছিল যে চোখে পানি চলে আসলো। আমার চোখে পানি দেখে উনি খুব বিব্রতবোধ করলেন। নিচু গলায় বললেন, “কষ্ট পেলে?”

নিচু হয়ে চোখের পানি মুছে দিলেন। শান্ত গলায় বললেন, “লুকোচুরি খেলবে? তুমি জিতলে হাওয়াই মিঠা কিনে দেব।”

উজ্জ্বল চোখে তাকালাম। লুকোচুরি আমার সবথেকে পছন্দের খেলা। লুকালেন উনিই। আমি খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম সহজে। খুশিতে হাততালি দিয়ে লাগলাম। এখনও মনে পড়ে তিনিও আমার সাথে খুব হেসেছিলেন। বিয়ের একমাসের মাথায় উনার সাথে শহরে চলে আসতে হলো। তার চাকরি এখানে। আমাকেও তার সাথে থাকতে হবে। চার কামরায় ঘর। দু’টো বাথরুম, বিশাল বড় রান্নাঘর। তবুও কেমন যেন দম বন্ধ লাগত। বাড়ির কথা মনে পড়ত, বাবা মাঝেমাঝে দেখতে আসতেন। শশুর শাশুড়ি তেমন আসত না। প্রতি মাসে দু’দিন শশুরবাড়ি যেতাম। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎই উনি কথাটা বললেন। বললেন, “তুমি পড়াশোনা করতে না?”

মন খারাপ হয়ে গেল। বিমর্ষ গলায় বললাম, “হ্যাঁ করতাম তো। তবে বাবা বলেছেন- আর পড়াশোনা করা যাবে না। এখন থেকে সংসার করতে হবে।”

উনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। কোমল গলায় বললেন, “পড়বে তুমি?”

উজ্জ্বল চোখে তাকালাম। তবে কিছু বললাম না। উনি হাসলেন। খুব সুন্দর করে হাসলেন। সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। পরদিন সকালে আমায় সাথে নিয়ে বের হলেন। যাবার আগে কিসব কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলেন। অনেকদিন বাদে খোলা বাতাসে ঘুরতে পেরে মন আনন্দে ভরে উঠল। আনন্দের ষোলকলা পূর্ণ হলো যঝন বুঝলাম উনি আমায় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। হেঁটে যেতে মিনিট দশেক সময় লাগে। ভর্তির কাজ শেষে শহরের বাজারে ঘুরতে নিয়ে গেলেন। প্রয়োজনীয় খাতাপত্র কিনে দিলেন। দু’টো গোলাপফুলও কিনলেন। সারাদিন উনার সাথে ঘুরলাম। মনে হচ্ছিল আজকে এই পৃথিবীতে আমার থেকে বেশি খুশি মানুষ আর নেই। একজনও না। বাসায় ফিরে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। ঝলমলে গলায় বললাম, “আপনি খুব ভালো।”

উনি যেন কেমন চোখে তাকালেন। হেসে বললেন, “তাই নাকি?”

ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। প্রথমদিকে দিন-কাল খুব ভালো যাচ্ছিল। সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজকর্ম সেরে ফেলতাম। নববীর আম্মু এসে ভাত তরকারি রান্না করে দিয়ে যেত। খাওয়া দাওয়া সেরে উনি সাথে করে নিয়ে স্কুলে দিয়ে যেতেন। সারাদিন স্কুল শেষে বিকেলবেলা সাথে নিয়ে ফিরতেন। ছুটির দিনগুলোতে রান্নাবান্না, ঘরের টুকটাক কাজ করা শেখাতেন। নববীর মা’য়ের কাছ থেকেও রান্না শিখতাম। শশুর বাড়ি যাবার সময় বইপত্র এখানে লুকিয়ে রেখে যেতাম। বললে অযথা সমস্যা হত। তবে একদিন ঝামেলা হলো। শশুর আব্বু বাসায় আসলেন। আসলেন হঠাৎই। না জানিয়ে চলে এসেছেন। এসে আমায় বাসায় পাননি। পড়াশোনার ব্যাপারটা উনার কাছে ধরা পড়ে গেল। উনি কঠিন মুখে বললেন, “বউ মা স্কুলে ভর্তি করিয়েছিস কেন? আমাদের বাড়ি বউয়েরা পড়াশোনা করে না।”

মানিক সাহেব ভাবলেশহীন গলায় বললেন, “মেঘা আমার বউ। আমার বউকে দিয়ে কি করাবো না করাবো এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এই ব্যাপারে আপনার কোন মন্তব্য সাজে না আব্বা।”

শশুর আব্বু ভীষণ রাগ করলেন। না খেয়েদেয়ে সেই রাতেই চলে গেলেন। তবে আমার পড়াশোনা বন্ধ হলো না। আগের মতোই চলতে লাগল। মানিক সাহেব রাতের বেলা স্কুলের পড়াগুলো দেখিয়ে দিতেন। আলাদা করে প্রাইভেট মাস্টার রাখতে হত না। তবে সমস্যা হলো ক্লাস নাইনে ওঠার পর। একদিন স্কুল শেষে মানিক সাহেবের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎই আমাদের ক্লাসের ফরিদ এসে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেল। আমি কিছু বলতে যাব এমন সময় দেখি মানিক সাহেব সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি চোখ-মুখ শক্ত করে কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখলেন। কাগজটা টুকরো টুকরো করতে করতে বললেন, “এই করতে স্কুলে পাঠাই আমি? এই করতে পাঠাই?”

উনার গলার স্বর এতটাই কড়া ছিল যে কেঁপে উঠলাম। নিচু গলায় বললাম, “আমি কিছু করিনি। ফরিদ দিয়েছে।”

উনি ভীষণ রেগে গেছেন। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আগে কখনও এতোটা রাগতে দেখিনি। হাত ধরে টানতে টানতে বললেন, “পড়াশোনা বন্ধ আজকে থেকে। কোন স্কুল নেই। আব্বা ঠিক বলেছিল- বউদের মাথায় তুলতে নেই।”

সেদিন রাতে উনি ভাত খেলেন না। বিছানা বালিশ নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন। আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। বুঝলাম না, আমার কি দোষ! আমি ত ফরিদের সাথে কথা বলি না। কখনও বলিনি। ও এসে কাগজ দিয়ে গেলে আমি কি করব! নাকি কিছু করা উচিত ছিল?
সেদিন সকালে প্রথম বারের মতো সবকিছু নিজের হাতে রান্না করলাম। গরুর গোশত ভুনা, চাপা শুটকি ভর্তা, লাউ চিংড়ি। খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে উনাকে ডাকতে গেলাম। গিয়ে দেখি, তিনি অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়ে আছেন। মুখ ফোলা ফোলা। চোখ লাল হয়ে আছে। দেখে খুব কষ্ট লাগছিল। কিছু বলব তার আগে উনি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। সেদিন আর স্কুলে নিয়ে গেলেন না। একা একা ঘরে বসে রইলাম। সারাদিন কেমন কেটেছে জানি না। মনে হচ্ছিল আমার কিছু নেই, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে যাচ্ছিল। উনি ফিরলেন রাত করে, বাড়ি ফিরতেই উনার পা জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “বিশ্বাস করেন, আমি ওর সাথে কথা বলি না। কখনোই না। সত্যি বলছি।”

উনি কিছু বললেন না। পা ছাড়িয়ে দিয়েন। পরক্ষণেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। ভেজা গলায় বললেন, “দুঃখিত। জানি তুমি কিছু করনি। তবে আমার সহ্য হয়নি। কারো পাশেই সহ্য হয় না। আমায় একটা কথা বলো তো, অমন সুন্দর করে কখনও আমার নাম নিয়েছ? কখনো ডেকেছ আমায়? কিংবা ওইভাবে তাকিয়েছ?”

কি বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে বুঝলাম আমার বয়স বেড়েছে। এখন আর বাচ্চাসুলভ আচরণ মানানসই হবে না। প্রতিটা কাজ খুব বুঝেশুনে করতে হবে। আমি অবিবাহিত নই, কেউ পছন্দ করলেই তাকে সহানুভূতি দেখাতে যাওয়া যাবে না। বিবাহিত মেয়েদের বয়স খুব দ্রুত বাড়ে। বড়দের সাথে মিশতে মিশতেই বাড়ে। অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষ পরীক্ষার শেষ দিন জানতে পারলাম সংসারে নতুন অতিথি আসছে। মানিক সাহেব খুশি দেখার মতো ছিল। এই হাসছেন ত এই কাঁদছেন। তার মেয়ে লাগবে। নামও ঠিক করে রেখেছেন। শশুর শাশুড়ি, মা বাবা সবাই ভীষণ খুশি। এতদিনের যত অভিযোগ সব যেন ধুয়েমুছে গেছে। শাশুড়ি মা নিজের গলা থেকে সোনার চেন খুলে পরিয়ে দিলেন।

সময় থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে মেয়ের বয়স চার বছর। মেয়ের জন্য এক বছর গ্যাপ হয়ে গেছিল ঠিকই তবে পড়াশোনা শেষ করেছি। একদিন খুব শখ করে বললাম, “আমার শিক্ষক হতে ইচ্ছে করে। বাচ্চাদের পড়াতে খুব ভালো লাগে।”

মানিক সাহেব নিজের হাতে ফরম তুলে আনলেন। হুমকির সুরে বললেন, “পরীক্ষায় ডাব্বা মা’র’লে তো বুঝেছ।”

নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলাম। ভাইবা পরীক্ষা দিন ভয় করছিল খুব। মানিক সাহেব সাহস দিয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠালেন। উনি নিজেই আসতেন। অফিসের কাজের জন্য আসতে পারলেন না। পরীক্ষা ভালোই হয়েছিল। তবে সবার কপালে সুখ সহ্য হয় না। পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি মানিক সাহেবের নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। সারা শরীর র’ক্তে মাখামাখি। অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ি এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছে। স্পটডে’ড! পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছে। পাখিরা গাইতে ভুলে গেছে। ফুলের কুড়ি শুকিয়ে গেছে। আমার বাগানে আর কখনও ফুল ফুটবে না, পাখি গাইবে না। চাকরির ফলাফল বের হলো। চাকরি পেয়ে গেছি। তবে জড়িয়ে ধরে আনন্দ করার মানুষ নেই। শশুর আব্বুর জোরাজুরিতে চাকরি জয়েন করলাম। শোক সামলাতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগলো। এখন আর হুটহাট কেঁদে উঠি না। স্কুলে ক্লাস করি, মেয়েকে পড়াই। একদিন হঠাৎই বাবা আসলেন। খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, “অনেকদিন হলো। এইবার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কর।”

“কি চিন্তা করব?”

“তোর মামা বলছিল- একটা ভালো ছেলে আছে। তার সাথে তোর বিয়ের ব্যাপারটা। চিন্তা কিসের, তুই নিজে রোজকার করিস। মেয়ের ভরণপোষণে সমস্যা হবে না। নয়না না হয় আমাদের কাছে রইল।”

শান্ত চোখে তাকালাম। বরফ শীতল কণ্ঠে বললাম, “মানিক সাহেব আমায় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। পড়িয়েছে, চাকরির ব্যাপারেও অমত করেনি। আপনি কি করছেন আব্বা? ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া চোদ্দ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। পড়াশোনার ব্যাপারে কোন সুযোগ রাখেননি। আজ মানিক নেই। তবে আপনি কোন মুখে বিয়ের কথা বলতে এসেছেন? সেদিন যদি মানিক আমায় না পড়াত, চাকরি না থাকত। আজ আমার বিয়ের জন্য ভালো ছেলে খুঁজে পেতেন কি? পেতেন না। একটা কথা বলি আব্বা। জানি বেয়াদবি। তবুও বলি – তাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা যায় না। কাউকেই না। আপনি দ্বিতীয়বার এই ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসবেন না। আসলে আমি ভুলে যাব আপনি আমার পিতা।”

বাবা বেরিয়ে গেলেন। মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলেন। তবে আমার কিছু করার নেই। দ্বিতীয়বার কিছু ভাবার সুযোগ নেই। হয়তো দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায়। তবে আমার জন্য তাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা যায় না।

সমাপ্ত

Exit mobile version