প্রিয়তা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না জানালো। আয়াজ ঠোঁট টিপে হাসলো। কে বলবে এই মেয়ে পেশায় একজন শিক্ষিকা? আয়াজের মনে হচ্ছে প্রিয়তাকে একটা চকলেট দিলেই সে কান্না থামিয়ে ফিক করে হেসে ফেলবে। এত আদুরে কেন তার প্রিয়?
কাজী অফিস থেকে আজ খুব হাসিখুশি মুখে বের হলে দেবো প্রিয়তার মুখটা থমথমে। সে এখনো বুঝতে পারছেনা কি থেকে কি হলো। আজ শুক্রবার হওয়ার সুবাদে সে বাসাতেই ছিল। আয়াজ কল করে ডাকায় সে ফুরফুরে মেজাজে দেখা করতে চলে আসে। কিন্তু আয়াজের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে সে থমকে যায়। কেমন এলোমেলো হয়ে আছে তার চুল। মুখটাও ফুলে আছে। প্রিয়তা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
‘কি হয়েছে? এমন কেন লাগছে তোমায়?’
উত্তরে আয়াজ যা বলে তা প্রিয়তাকে আবারো কাঁপিয়ে দেয়।
‘আমায় বিয়ে করতে পারবেন প্রিয়?’
‘কি হয়েছে আয়াজ? এসব কেন বলছ?’
‘পারবেন?’
প্রিয়তা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়।
‘অবশ্যই।’
এরপর আয়াজ আর কোনো কথা বলে না। একটা রিকশা ঠিক করে তাতে চড়ে বসে। সুপারমার্কেটের পাশের চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাজী অফিস। কাজী অফিসের সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রিয়তা নড়েচড়ে ওঠে। বুকের ভেতর অজানা কারোনে ডিপডিপ করছে। নাকে ছোট ছোট ঘামকণা জমতে শুরু করেছে।
‘এখানে কেন আমরা আয়াজ?’
‘কাজী অফিসে যে কারণে আসে মানুষ সে কারণে।’
এরপর যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। আপাতত প্রিয়তা শক্ত করে আয়াজের হাত ধরে আছে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কত কিছু হয়ে গেল তার জীবনে। এখন সে বিবাহিত। তার একটা পিচ্চি বর আছে। প্রিয়তা কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করল,
‘এখন আমরা কোথায় যাব আয়াজ?’
আয়াজ সময় নষ্ট না করে সহজ গলায় বলে,
‘কুঠিবাড়ি।’
কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে প্রিয়তার ভাবতে। অতঃপর মনে পড়ে এটা আয়াজদের বাড়ির নাম। প্রিয়তার ভিষণ মন খারাপ হলো। আজ তার বিয়ে হলো অথচ তার কোনো পরিবার নেই। না আছে কোনো অভিভাবক। সে নিজেই নিজের সব। আজ মা থাকলে নিশ্চয়ই তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আয়াজের হাতে তুলে দিত। প্রিয়তার বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে পা বাড়ালো তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। তার জানা নেই কি হতে চলছে। কিন্তু তবুও তার কোনো ভয় নেই। পাশের মানুষটার হাতে হাত রেখে সে ভয়হীন ভাবে মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে পারবে।
মাথার উপরের সিলিং ফ্যানটা ভনভন করে ঘুরছে। ভাবসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আয়াজ। শাকিলা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিলো ছেলের দিকে। তোরিকুল সাহেব বিরক্তি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। পানি শেষ করে আয়াজ বাবার চোখে চোখ রাখল। শান্ত শীতল গলায় বলল,
‘এত জরুরি তলব কেন?’
তরিকুল সাহেব সোজা হয়ে বসলেন। গমগমে সুরে বললেন,
‘তোমাকে কেন জরুরি তলব পাঠানো হয়েছে তার কারণ নিশ্চই আমাকে বলতে হবে না। যথেষ্ট বুদ্ধিমান তুমি।’
‘জি। আমার মনে হয় কারণটা আমি বুঝতে পেরেছি। আর এজন্যই আপনার মতামত শুনতে আগ্রহী আমি।’
তরিকুল সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। ছেলের এমন শান্ত শীতল কন্ঠ তাকে তার জায়গা থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে তিষি ভিষণ বিরক্ত বোধ করলেন। গলার স্বর কঠিন করে তিনি বললেন,
‘সমাজে আমার একটা সম্মান আছে। তোমার এটা ভুলে গেলে চলবেনা। পাঁচ বছরের বড় একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছ। এ কথা লোকে জানলে কি হবে বুঝতে পারছ? তোমার আমার রেপুটেশনের কথা একবার ভাবা উচিত ছিল।’
আয়াজ ধৈর্য হারালো না। তার ভাব-ভঙ্গি স্বাভাবিক। প্রগাঢ় শান্ত কন্ঠে বলল,
‘বিয়েটাতো আমি করেছি বাবা। রেপুটেশন কেন আপনার নষ্ট হবে? কেউ কিছু বলতে এলে তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। আমি বুঝে নিব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন।’
তরিকুল সাহেব খুক খুক করে কেশে উঠলেন। এই মুহূর্তে তার নিজের ছেলেকে চরম অসভ্য অভদ্র বলে মনে হচ্ছে। বাপের থেকে বেশি বুঝতে শিখে গেছে। এই ছেলেকে অসভ্য ছাড়া আর কি বলা যায়?
তরিকুল সাহেব থামলেন। গম্ভীর হয়ে ছেলেকে দেখলেন। তার ছেলের ভেতর আত্মবিশ্বাস জেদ সর্বদাই বেশি। ছেলে যা করছে সব তার জেদ। একবার জেদ থেকে বের হয়ে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রিয়তাকে তার দেখতে শুনতে খারাপ লাগছ না। কিন্তু তবুও কেন জেন মেয়েটাকে তার ভিষণ অপছন্দ। বয়সে বড় তাই? হয়তো। তরিকুল সাহেব পুনরায় আয়াজের দিকে মন দিলেন। ভিষন গম্ভীর অথচ শান্ত গলায় বললেন,
‘তোমার বউয়ের জন্য এ বাড়ির দরজা বন্ধ। আমার অফিসেও তোমার জায়গা হবেনা যদি তুমি তোমার কথায় অটল থাক। ভেবে দেখো কি করবে। আমার কথা শুনলে বাড়ি ফিউচার সব তোমার হাতের মুঠোয়। আর অন্যথায় সব থেকেও তোমার কিছুই নেই।’
তরিকুল সাহেব সন্তুষ্ট চিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। তার ছেলে ভিষণ বুদ্ধিমান। সামান্য একটা মেয়র জন্য সব কিছু সেক্রিফাইস করে বোকামি নিশ্চই করবে না। তিনি আনন্দিত হয়ে শাকিলা বেগমকে ডাকলেন। আবদার করে বললেন,
‘এক কাপ গরম চা আর গরম গরম পাকোরা বানাও তো। তোমার হাতের পাকোরা মিস করছি।’
শাকিলা বেগম তরিকুল সাহেবের হাসি হাসি মুখ দেখে খুশি হলেন। নিশ্চই সব স্বাভাবিক হয়েছে! পরিবারে তাহলে সুখ নামলো বোধহয়!
কিন্তু তিনি জানতেন না পরিবারের শেষ সুখ টুকুও ধূলিস্যাৎ করেই আনন্দে মেতেছে তরিকুল সাহেব।
প্রিয়তা ভিষণ মন খারাপ নিয়ে কাবার্ড থেকে আয়াজের কাপড় বের করে গোছাতে লাগলো। সে একটা পরিবার পাবে একটা মা পাবে এতসব ভাবনা নিয়েই এ বাড়িতে পা রেখেছিল সে। কিন্তু তার মেয়াদকাল এ বাড়িতে একটা রাত ও হলো না। সে কি এমন পোড়া কপাল নিয়েই জন্মেছে? প্রিয়তা আঁচলে চোখ মুছল। একবার ভালো করে আয়াজের রুমটা দেখে নিলো। এই রুমটায় ঢোকার পর তার ভিষণ আপন মনে হয়েছিল। কিন্তু কি হলো? প্রিয়তা উদাস মনে হেঁটে বারান্দায় গেল। আয়াজের রুমের বারান্দাটা বিশাল। জানা অজানা বিভিন্ন ফুলের গাছ আছে এখানে। এখানে বসে চন্দ্রবিলাস করা যেত। মাত্র কয়েক ঘন্টায় প্রিয়তা অনেক কিছুই ভেবে নিয়েছিল কিন্তু তার কিছুই হলোনা ভেবে মুখ কালো করলো সে। এরি মাঝে আজ এলো রুম। প্রিয়তাকে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে দাঁড়ালো। পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে কাঁধ থুতনি ছোয়াল। প্রিয়তা চমকে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলো।
‘মন খারাপ কেন বউ?’
আয়াজের মুখে বউ ডাক শুনেই প্রিয়তা কেঁদে ফেলল। আয়াজ থতমত খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘কাঁদছেন কেন?’
‘তুমি কথা রাখোনি আয়াজ। তোমার পরিবার আমায় মেনে নেয়নি।’
আয়াজ আলতো করে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তাকে। শান্ত করার গলায় বলল,
‘আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি প্রিয়তা। এর থেকে বেশি কি চাই আপনার?”তুমি অবিবাহিত মেয়ে। তোমার ঘরে একটা ছেলে কি করছে?’
প্রিয়তা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘দাদু ভেতরে আসুন না! ভেতরে এসে কথা বলি।’
বৃদ্ধ গোমড়ামুখি বাড়িওয়ালা নড়লো না। ধারালো দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর মাঝে রুম থেকে আয়াজ বের হয়ে এলো। প্রিয়তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে সালাম দিল বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে।
‘আপনি আমার বউকে ধমকাচ্ছেন এটা কিন্তু মোটেই ভালো কাজ নয় দাদু।’
লোকটা বিষ্ময় নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকালো।
‘মেয়ে তুমি বিয়ে করলে কবে?’
প্রিয়তা উত্তর দেওয়ার আগেই আয়াজ উত্তর দিলো,
‘এইতো আজ। দুপুর বারোটা পয়ত্রিশ মিনিটে।’
লোকটার দুভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়লো। সে হয়তো আয়াজের কথাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই সে সন্দিহান গলায় প্রিয়তাকে বলল,
‘এই ছেলেকি তোমার স্বামী? নাকি ফাঁকি দিতে চাইছ আমাকে?’
আয়াজ কথা বলতে নিলে প্রিয়তা থামিয়ে দিলো তাকে। মুখে হাসি এনে বলল,
‘সত্যিই আমরা বিবাহিত দাদু। বিশ্বাস না হলে আসুন কাগজ পত্র দেখাচ্ছি আপনাকে।’
বৃদ্ধ এবার মাথা নাড়ালো। চলে যেতে নিয়ে আড়চোখে একবখর আয়খজের দিকে তাকালো। আয়াজ তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ নাক কুঁচকাল। বিরবির করল,
‘বিচ্চু ছেলে।’
রাতের রান্নাটা প্রিয়তা নিজ হাতেই করলো। খুব যত্ন নিয়ে সে আয়াজের জন্য রুই মাছ ভুনা করেছে সাথে বেগুন ভাজি। এ দুটো খাবার আয়াজের পছন্দের। ফ্রিজে মাংস নেই। তাই এ দিয়েই আজ চালাতে হবে। প্রিয়তা রান্নার ফাঁকে বেশ অয়েকবার উঁকি দিলো। আয়াজ ঘুমাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেডে হেলান দেয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা। ঘাড় ব্যাথা করবে তো! প্রিয়তা ভাবলো একবার ডেকে দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই আয়াজের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছা হলো না তার। প্রিয়তা ঘুমন্ত আয়াজকে অবলোকন করল। সুঠামদেহী প্রিয় পুরুষটার ঘুমন্ত রূপ ভয়ংকর। এত কেন সুন্দর! আয়াজের ঘুমন্ত সরল মুখ দেখে প্রিয়তার মনে কিছু অবাধ্য ইচ্ছা ছুটাছুটি করতে লাগলো। সে কি একটু ছুঁয়ে দিবে? পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তার গাল। বিয়ে করতে না করতেই তার ভিতর এমন লুচু স্বভাব চলে এসেছে। নট ফেয়ার! প্রিয়তা জোরে নিঃশ্বাস নিলো। প্রিয়তা নিজেই আয়াজকে বিছানায় শুয়ে দিতে চাইলো।
‘আপনার এই চুনোপুঁটির শরীর এতবড় আমাকে নাড়াতে পারবে না।’
প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে তাকালো। রাগি কন্ঠে জবাব দিলো,
‘ঘুমাওনি যখন ভান ধরে ছিলে কেন?’
‘দেখছিলাম। একা পেয়ে আমার সুযোগ লোটার চেষ্টা করেন কিনা।’
আয়াজ কথাটা বলে চোখ টিপল। প্রিয়তা লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করলো না। এই ছেলে যদি একবার বুঝতে পারে প্রিয়তা লজ্জা পেয়েছে তবে সময়ে সময়ে সে প্রিয়তাকে লজ্জায় ফেলবে। সে আয়াজকে চোখ গরম দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। এমন বিচ্চু ছেলের সাথে সংসার কিভাবে করবে সে?
রাতের আকাশ ভিষণ সুন্দর। শিরশির বাতাসে শীতশীত লাগছে। আজ আবহাওয়া বেজায় ঠান্ডা। প্রিয়তা গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো করে গায়ে পেঁচিয়ে নিল। প্রায় রাতে সে এভাবে ছাদে এসে দাঁড়ায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। মনের সকল অসুখ যেন এভাবেই বের করে ফেলে সে। প্রিয়তার ফোনে টুংটাং শব্দ হয়।
‘লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? রুমে আসুন। অনেক রাত হয়েছে।’
প্রিয়তা ম্যাসেজটা দেখে ফোন পাশে রেখে দিল। তার ভিষণ রকম লজ্জা অনুভব হচ্ছে। এটা তাদের প্রথম রাত। লজ্জাটা স্বাভাবিক। প্রিয়তা দাড়িয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ। দুরুদুরু মন নিয়ে ছাদ থেকে নিচে নামল। ফ্লাটের দরজাটা চাপানোই আছে। পুরো ফ্লাট ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রিয়তা আলগোছে দরজা বন্ধ করে অন্ধকার হাতড়ে রুমে প্রবেশ করে। আবছা আলোয় সে দেখতে পায় আয়াজ বেডে অন্যপাশ ঘুরে শুয়ে আছে। প্রিয়তা ঢোক গিলে এগিয়ে যায়। কোনো শব্দ ছাড়া একপাশে চুপটি করে শুয়ে পড়ে। বিরবির করে,রাতটা যেন দ্রুত কেটে যায়। খিচে চোখ বন্ধ করে রাখতেই অনুভব হয় একটা হাত তাকে আঁকড়ে ধরেছে। তার খোঁপা করা চুলরাশি মেলে দিয়ে মুখ গুঁজেছে তার উন্মুক্ত ঘাড়ে। প্রিয়তা জমে যায়। নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যেন। তার মনের সাথে সাথে দেহ ও যেন শত্রুতা শুরু করেছে তার সাথে। আয়াজ কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
‘এবার পালান!’
প্রিয়তা উত্তর দিতে পারলো না। কেবল নিজেকে শুধাল,’আমার দেহ,আমার মন আজ আমার-ই বিরুদ্ধে রুখেছে।’
সকালে প্রিয়তার ঘুম ভেঙেছে বেশ বেলা করে। ঘুম থেকে উঠে সে আয়াজকে পেল না। চুল হাতখোপা করে বিছানা থেকে নামতেই ব্যাথায় টনটন করে উঠলো শরীর। বিছানার একপাশে আয়াজের শার্ট পড়ে আছে। প্রিয়তা শার্টটা স্বযত্নে তুলে নিলো। শার্ট থেকে পরিচিত সিন্ধ একটা সুবাস এসে ধাক্কা লাগলো নাকে। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে সুবাস নিলো। কেমন একটা আয়াজ আয়াজ ঘ্রাণ।
আয়াজ মার্কেটে এসেছে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কিনতে। প্রিয়তার বাসায় শোবার খাট, টেবিল আর টোট্ট একটা কাপর রাখার র ্যাক ব্যতীত কিছুই নেই। সামনের রুমটা পুরোটাই ফাঁকা পড়ে আছে। কাল থেকেই আয়াজ চাকরির খোঁজ করতে নামবে। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত এই ছোট ফ্লাটেই মানিয়ে নিতে হবে। আয়াজের ফোন বেজে উঠলো। শাকিলা বেগম কল করেছেন। আয়াজ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শাকিলা বেগম কেঁদে ফেললেন।
‘কেমন আছ বাবা?’
‘ভালো আম্মু। আপনার দোয়ায় ভালো আছি। কাঁদছেন কেন?’
আয়াজের কথা শুনে শাকিলা আরো জোরে কেঁদে ফেললেন।
‘বাবা প্রিয়তাকে নিয়ে বাসায় চলে আসো। তোমাকে ছাড়া সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তোমার বাবার কথায় রাগ করো না।’
আজায় জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। শান্ত কন্ঠে বলল,
‘প্রিয়তা আমার স্ত্রী আম্মু। তার অসম্মান আমি মেনে নিব না। আমার জন্মদাতা পিতা আমার ভালোবাসাকে একান্তই ছেলেখেলা ভেবে নিয়েছে। তিনি টাকার মাধ্যমে আমার ভালোবাসা কিনতে চেয়েছে আম্মু। এতটা অসম্মানের পর কিভাবে ফিরে আসি?’
‘আমি কি অপরাধ করেছি বাবা? শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছ?’
‘আপনি কোনো অপরাধ করেননি আম্মু। আপনার যখন ইচ্ছা হবে নাজিম চাচাকে বলবেন। তিনি আপনাকে আমার বাসায় পৌঁছে দিবে।’
আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দিল আয়াজ। তার বাবা ভিষণ ভালো মানুষ। আয়াজ তাকে অনেক সম্মান করে। কিন্তু তবুও তিনি তার প্রিয়তাকে হেলা করেছেন। এর মাফ তখনি হবে যখন সে নিজ থেকে আয়াজকে প্রিয়তার সহিত ঘরে ফিরে আসতে বলবে।
আয়াজ যখন ফিরল তখন দুপর বারোটা। প্রিয়তা গালে হাত রেখে বারান্দায় বসে ছিল। অপেক্ষা করছিল আয়াজ আসার। লজ্জার কারণে আয়াজকে কল দিতে পারেনি। ছোট একটা ট্রাক ভর্তি মালজিনিস এনে থাকম গেটের সামনে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। সোফা,কাবার্ড,ডায়নিং টেবিল,ড্রেসিং টেবিল। এতকিছু? এতকিছু কোথায় রাখবে? প্রিয়তা একবার ঘরে নজর বুলাল। সবকিছু ধরবে তবে একটু গাদাগাদি হবে।
গোছগাছ করতে করতে তিনটা বেজে গেল। খাওয়া দাওয়া হয়নি। রান্নাটাও করা হয়নি। ঘামে আয়াজের শার্ট ভিজে চুপচুপ করছে। প্রিয়তা রান্নাঘরে গেল। লেবু দিয়ে এক গ্লাস শরবত করল। আয়াজকে শরবত দিতেই আয়াজ বাঁকা চোখে তাকালো। মিষ্টি হেসে বলল,
‘ধন্যবাদ বউ।’
এই সামান্য কথাতেও প্রিয়তার গাল কেমন লাল হয়ে উঠলো। আয়াজের মুখে্য বউ কথাটা তার ভিষণ প্রিয়। বুকের ভেতর আলাদা রকম শান্তি লাগে।
‘আজ স্কুল ছিল না?’
আয়াজের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় প্রিয়তা। ছোট করে উত্তর দেয়।
‘ছিল। ছুটি নিয়েছি দুদিনের।’
‘বরকে সময় দিতে?’
প্রিয়তার কান গরম হয়ে গেল। ছেলেটা সবসময় তাকে লজ্জায় ফেলার চেষ্টা করে। প্রিয়তাকে লজ্জা পেতে দেখে আয়াজ প্রগাঢ় হাসলো। কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘রান্নাতো হয়নি। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিন। বাইরে থেকে খেয়ে আসবো।’হাঁটার মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা বারবার আয়াজের পানে তাকাচ্ছে আবার নিজেকে দেখছে। কখনোবা নিরবে দুজনের হাইট মাপছে। সে আয়াজের থেকে অনেকটাই খাটো। মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট লম্বা হলেও আয়াজের কাঁধ সমান তার হাইট।
‘ফুচকা খাবেন?’
প্রিয়তার পেট ভরা। তবুও সে এমন সুন্দর অফার মিস করতে চাইল না। মাথা ঝাঁকাতেই আয়াজ তার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। প্রিয়তা আবারো মুগ্ধ হয়ে তাকালো আয়াজের পানে। কত যত্নশীল ছেলেটা। তার মনের মাঝে প্রেমের হাওয়া বইতে লাগলো। এই ছেলের প্রেমেতো সে বহু আগেই পড়েছে। তবুও নতুন ভাবে যেন সে প্রেমে পড়ছে। প্রিয়তা বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করলেও আয়াজের জন্য তা পারল না। আয়াজের চোখ রাঙানিতে ভদ্র মেয়ের মতো অল্প ঝালে এক প্লেট ফুচকা নিলো। আয়াজ খেল না।
‘তুমি কেন খাচ্ছ না?’
‘এসব আনহাইজেনিক ফুড আমি পছন্দ করি না।’
প্রিয়তা মুখ বাঁকাল। ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে খোঁচা দিল।
‘নিজে খাওনা কিন্তু বউকে তো বেশ খাওয়াচ্ছ। তাড়াতাড়ি মেরে অন্য একটা বিয়ে করার ধান্দা। বেশ বুঝেছি আমি!’
আয়াজ শীতল চোখে তাকালো। কোনো কথা না বলে প্রিয়তার হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিল। প্রিয়তা সবে তিনটা ফুচকা খেয়েছে। বাকি ফুচকা প্লেট কাত করে ময়লার বালতিতে ফেলে দিল আয়াজ। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠলো।
‘এই কি করছ! খাবো তো!’
আয়াজ বাঁকা হাসলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘যদি মরে যান? দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই আমার।’
প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এভাবে ফেঁসে যাবে বুঝতে পারেনি। খুব আফসোস হলো। ওমন কথাটা বলা কি খুব জরুরী ছিল? গাল ফুলিয়ে আয়াজের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল। দ্বিতীয়বার আর সে এই ছেলের পেছনে লাগবে না।
পেপার হাতে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তরিকুল সাহেব। শাকিলা উশখুশ ভাবে পায়চারি করছে। এতবছরের সংসারে এখনো তিনি স্বামীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। তার উৎকণ্ঠা চোখের আড়াল হলো না তরিকুল সাহেবের। তিনি আড় চোখে অবলোকন করে বললেন,
‘কিছু বলবে?’
শাকিলা সাহস পেল। এগিয়ে এসে পাশে বসলো। ধরে আসা গলায় বললো,
‘ছেলেটার খোঁজ নিয়েছেন?’
আয়াজের কথা স্মরণ হতেই চোয়াল শক্ত হলো তরিকুল সাহেবের। হাতের পেপারটা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে জ্বলন্ত চোখে চাইলেন। তীব্র রাগ নিয়ে তিনি হুংকার ছাড়লেন।
‘তোমার ঐ অভদ্র বেয়াদপ ছেলের কথা আমায় বলবেনা। কতটা অবাধ্য হলে এভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়! আমার সম্মানের কথা একবারও ভাবলো না।’
শাকিলা বেগম অসহায় মুখে তাকালেন। অনুনয় করে বললেন,
‘ছোট ও। না বুঝে ভুল করে ফেলেছে। আপনি এভাবে রাগলে মানায়?’
তরিকুল সাহেব বিরক্তি নিয়ে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বললেন,
‘তোমার ছেলে যে ছোট বিয়ে করার সময় মাথায় ছিল না তার? তুমি বা কোন আক্কেলে ছোট ছেলের বউকে ধেই ধেই করে বরণ করতে গেলে! বোঝাতে পারলেনা সে ছোট বিয়ে করার বয়স হয়নি!’
শাকিলা হতাশ হলেন। বাপ-ছেলে কেউ কারো থেকে কম না। এভাবে চললে এর শেষটা কিভাবে হবে! সে তো মা! সন্তান বাড়ির বাহিরে আছে। কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুদন্ড স্থির থাকতে পারছেন না তিনি। একটা মাত্র ছেলে একটুনাহয় অবাধ্য হয়েছে। তাই বলে এভাবে বের করে দিতে হবে কেন? চোখ জ্বলে উঠলো তার। ভিষণ অভিমান হচ্ছে তার। ছেলেটাও বা কম কিসে? বাপ বলল অমনি সুরসুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মায়ের কথা একবার ও ভাবল না। শাকিলা শব্দ করে রুমের দরজা বন্ধ করলেন। ছেলে বাড়ি ফিরলে তবেই এই দরজা খুলবে। অন্যথায় সে রুমের বাহিরে এক পা ও ফেলবে না। আর নাইবা খাবে। দেখা যাক পানি কতদূর গড়ায়।
রোদ ঝলমলে সকাল। প্রিয়তার অফ পিরিয়ড চলছে। আয়াজকে কয়েকবার কল করেও পেল না। প্রিয়তা ওদিকে তেমন পাত্তা দিল না। হয়তো ব্যস্ত আছে।
‘প্রিয়তার মুখ উজ্জ্বল লাগছে খুব। কারণ কি?’
প্রিয়তা তাকালো। তার সামনের ডেস্ক থেকে শর্মিলা ম্যাম হাস্যজ্জল মুখ নিয়ে প্রশ্ন করেছে। তিনি এই স্কুলে সবথেকে সিনিয়র। বয়স চাকরি দুদিক থেকেই। তাছাড়া ভিষণ মিশুক। কেমন হেসে হেসে কথা বলে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। বিয়ের কথা বলেকি সে সবাইকে একটু চমকে দিবে? কিন্তু হাতে টাকা নেই। এভাবেতো বলা যায় না। তাই সে চেপে গেলো। মিষ্টি হেসে বলল,
‘আমার হাসতে মানা?’
‘তা নয়। তবে তোমার হাসি তো ধুমকেতুর মতো। বহু অপেক্ষার পর দেখা মেলে। তাই কিউরিয়াস!’
প্রিয়তা মুচকি হাসলো। কোনো জবাব দিলো না। কি বা জবাব দিবে?
আজ বহুদিন পর নিখিলের সাথে দেখা। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখা হয়ে গেল।
‘কেমন আছেন ম্যাডাম? আপনাকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তো খোঁজ পাওয়া যায় না।’
অনেকটা টিটকারী করেই বলল নিখিল। প্রিয়তার মন আজ ভীষণ রকম ভালো। মন ভালো উপলক্ষে নিখিলের এই সামান্য কথাকে গায়ে মাখাল না সে। সৌযন্যমূলক হেসে বলল,
‘এই একটু ব্যস্ত ছিলাম মাত্র।’
‘এতটাই ব্যস্ত যে সামান্য ম্যাসেজ ওপেন করার সময়টাও হয়নি!’
নিখিলের কন্ঠ জুড়ে হতাশা। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট গুলো অভিমাণ হয়ে বের হতে চাইল। নিখিল রুখল। তার সামনের এই রূপবতী রমনীর কৃষমতা নেই তার হৃদয়ের ব্যাথা অনুভব করার। তার অভিমান গুলোকেও হয়তো সে অবহেলায় উড়িয়ে দিবে ঠিক যেভাবে মেয়টার মোবাইলে এক অংশে তার পাঠানো ম্যাসেজ গুলো পড়ে রয়েছে নিদারুণ অবহেলায়। নিখিল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুখে মিথ্যা একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে ব্যাথিতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘এক কাপ কফি একসাথে বসে খাওয়ার মতো বন্ধুত্বটুকু আছে নিশ্চয়ই!’
প্রিয়তা নিখিলের আকুতি ভরা দৃষ্টি দেখলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সম্মতী জানালো। প্রিয়তার বলতে ইচ্ছা হলো,’আমার যদি আরো একটা হৃদয় থাকতো সেখানেও হয়তো আপনাকে দেওয়ার মতো বিন্দু জায়গা অবশিষ্ট থাকতো না। আমার পিচ্চি বরটা জানেন তো ভিষণ হিংসুটে। দুটো হৃদয়েই থাকতো তার রাজত্ব। আপনি তখনো কষ্ট পেতেন। এখনো পাচ্ছেন। এটা আপনার ডেস্টিনি। যা হয়তো আপনিই চেয়ে এনেছেন!’
মানুষের ডেস্টিনি সত্যিই অদ্ভুত। কেউ জানে না তার ভাগ্যে কি আছে। কি হবে বা হতে চলেছে। প্রিয়তাও কি জানত সে তার অতি বরক্তিকর এক পিচ্চিকে এতটা ভালবেসে ফেলবে। কিংবা তার সাথেই ঘর বাঁধবে! কিন্তু সেটাই হয়েছে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে মানুষের জীবনে। কিছু ঘটনা খুব নাটকিয় ভাবে ঘটে যা নিঃসন্দেহে কোনো অস্কার প্রাপ্ত সিনেমাকে হার মানাবে। ঠিক প্রিয়তার জীবনের গল্পের মতো করে।
এই রেস্টুরেন্টে প্রিয়তা আগেও এসেছে। নিখিলের সাথেই। এখানের কফিটা ভালো। পরিবেশটাও ভিষণ সুন্দর। এমন নিরব পরিবেশ আয়াজের ভিষণ পছন্দ। প্রীয়তা চট করে ভাবল আয়াজকে সাথে নিয়ে এখানে একদিন আসবে। দুজন এই নিরব পরিবেশে কিছুটা সময় পার করবে।
কফি এসেছে। প্রিয়তা তৃপ্তি নিয়ে কফিতে চুমুক বসালো। উদাস গলায় বলল,
‘আপনার বোধহয় একটা বিয়ে করে ফেলা উচিত নিখিল। এভাবে অন্যের বউয়ের পেছনে ছোটা মোটেই শোভনীয় নয়।’
নিখিল প্রিয়তার কথা বুঝলো না। প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো। প্রিয়তার মায়া হলো। মানুষের হৃদয় ভাঙতে ভিষণ রকম দুঃখ দুঃখ অনুভব হয়। তার ও হচ্ছে। প্রিয়তা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে কথা সাজিয়ে নিল। কিন্তু বলার সময় এলোমেলো অগুছালো হয়ে গেল।
‘রিসেন্টলি একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
নিখিল আগ্রহ নিয়ে চাইল। ভ্রুদয়ের মাঝে সামান্য ভাঁজের সৃষ্টি হলো। নিখিলের আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েই প্রিয়তা ঝটপট বলল,
‘বিয়ের মতো অত্যন্ত চমৎকার কাজটা আমি করে ফেলেছি।রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে প্রিয়তা সোজা হাঁটতে শুরু করেছে। বাসের জন্য তাকে আর নাহলেও দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো। অদ্ভুত ভাবে আজ একা হাঁটতেও ভিষণ আনন্দ অনুভব হচ্ছে। নিখিলকে সবটা জানাতে পেরেও নিজেকে হালকা লাগছে। হয়তো সে একটু কষ্ট পেয়েছে কিন্তু একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
প্রিয়তার আজকাল নিজেকে সুখি মানুষ মনে হয়। সম্পূর্ণ লাগে নিজেকে। টোনা টুনির সংসার তার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। ছোট হাঁড়িতে করে ভাত রান্না, একটা মুরগি, একপদের মাছ আর সবজি দিয়ে সপ্তাহ পার করা। এসব যেন ভিষণ ইন্টারেস্টিং ঠেকছে তার কাছে। খুব বেশি বিলাসিতা নয় আবার অভাব ও না। একদম সচ্ছ সাচ্ছন্দ্যের সংসার তার। তার নিজ হাতে গড়া নিজের সংসার।
শীতের আমেজ পড়ে গিয়েছে। বিকেল হতেই ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস শরীর মন দুটোকেই শীতল করে দিচ্ছে। প্রিয়তার অবশ্য এই শীতকালটা ভিষণ অপ্রিয়। কাজে বড্ড আলসেমি অনুভব হয়। চোখ জুড়ে শুধু ঘুম ঘুম পায়। ভোরে উঠে স্কুলে যেতে প্রায় শরীর আর মনের সাথে যুদ্ধে নামতে হয়। তখন মন চায় বাচ্চাদের বলতে তোমাদের ছুটি। পুরো শীতকাল জুড়ে তোমরা কেবল ঘুমাবে। তোমাদের দায়িত্ববান শিক্ষিকা হিসেবে আমিও অত্র কাজ যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ করব।
আয়াজ দুপুরে বাসায় ফেরেনি। একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। প্রিয়তা চিন্তিত হয়ে ডায়াল করলো আয়াজের নাম্বারে। কিন্তু অফ বলছে। প্রিয়তা মন খারাপ করলো। এভাবে গায়েব হ ওয়ার মানে কি? আয়াজ জানেনা প্রিয়তা তার জন্য অপেক্ষা করছে? তার লেট প্রিয়তাকে কতটা টেনশন আর পীড়া দেয় তা সে বোঝেনা?
আয়াজ যখন ফিরল তখন রাত দশটা। ক্লাঞ্ত শরীরটাকে টেনে দ্বিতীয় তলা অবদি তুলতে তার ভিষণ কষ্ট হলো। পরিপাটি মানুষটার চেহারায় কেমন বিধ্বস্ত অবস্থা। পরপর দুবার বেল দিতেই দরজা খুলে গেল। প্রিয়তা দরজা খুলে চুপ করে পাশ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভুল করেও একবার চাইল না আয়াজের পানে। আজ তার মন ভিষণ খারাপ। আয়াজ প্রিয়তার দিক তাকিয়ে অল্প হাসার চেষ্টা করল। ক্লান্ত মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘খেয়েছেন?’
প্রিয়তা এ কথার উত্তর দিল না। রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবার গরম করছি।’
আয়াজ ব্যথিত হলো। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে প্রিয়তার পানে চাইল। কিন্তু পাষাণ রমণী মুখ তুলে চাইল না। না দেখলো আয়াজের করুণ সে দৃষ্টিকে। আয়াজ লম্বা করে বেডে শুয়ে পড়লো। মাথাটা ধরেছে খুব। গলা উঁচিয়ে সে প্রিয়তাকে ডাকল।
‘এক কাপ কফি হবে?’
জবাব এলো না। আয়াজ চোখ বন্ধ করলো। চাকরিটা তার হয়নি। চাকরির সন্ধানে তার এক বন্ধুর মামার সাথে দেখা করতে মিরপুর গিয়েছিল। ঘন্টাখানেক দাড়িয়ে থেকে তবেই তার দেখা পেয়েছে। সেখান থেকে বের হতেই জানতেপারে শাকিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। সে অবস্থাতেই সে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটেছে। আল্লাহর রহমতে তেমন কিছু হয়নি। না খেয়ে থাকার কারণ বসত দুর্বল হয়ে সেন্স হাড়িয়েছে। সেলাইন দিয়েছে ডাক্তার। আজ রাত থেকে কাল তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। সকাল থেকে একনাগাড়ে এত দৌড়াদৌড়িতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তাছাড়া দুপুর থেকে পেটে কিছু পড়েনি।
‘কফি নাও।’
আয়াজ চোখ মেলল। প্রিয়তা এখনো তার দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বউয়ের অভিমানটা তার ভালো লাগলো। আয়াজ ধীরে উঠে বসলো। প্রিয়তার হাত থেকে কাপ নিয়ে তার হাত ধরে কাছে টেনে বসালো। যত্ন করে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিল। আদুরে ভাবে বলল,
‘এত অভিমান এর কারণ?’
প্রিয়তা জবাব দিল না। আজ সে পন করেছে আয়াজের কোনো মিষ্টি কথায় সে ভুলবে না। আয়াজ মুচকি হাসলো। সে জানতো উত্তর পাবেনা সে। এতদিনে প্রিয়তার এসব স্বভাব সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই পরিচিত হয়েছে সে।
‘মা অসুস্থ প্রিয়। হসপিটালে এডমিট। হঠাৎ করে খবর পাওয়ায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আপনাকে জানানোর কথা মাথায় ছিল না। প্রমিস আর এমন হবে না।’
প্রিয়তা চমকালো। মা সুলভ মানুষটা অসুস্থ শুনতেই বুকের ভেতর কেমন করলো। যদিও পরিচয় খুব বেশি দিনের না। কিন্তু অল্পতেই মানুষটা কেমন করে যেন প্রিয়তার প্রিয়ের তালিকায় নাম করে নিয়েছে। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠলো। তার মন খারাপ হলো ভিষণ রকম। তার মুখে আঁধার নামতে দেখে আয়াজ তাকে নিশ্চিত করলো তিনি সুস্থ আছেন। তবুও প্রিয়তার অশান্ত মনটা শান্ত হলো না।
‘আপনি আমার যত্ন নিচ্ছেন না বউ।’
তোয়ালে হাতে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলল আয়াজ। সদ্য গোসল করায় চুল থেকে টুপটাপ পানি পরছে। উদম দেহটাতেও পানিকণা বিন্দু বিন্দু আকারে জ্বলজ্বল করছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকালো প্রিয়তা। প্রেম সাগরে উপচে পড়লো ঢেউ। এত সুন্দর কেন! প্রিয়তা জানে আয়াজ ইচ্ছে করেই এরূপে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তবুও সে নিজেকে আটকাতে পারল না। যাকে বলে নিজ পায়ে কুড়াল দেওয়া। তেমনটাই করলো সে। তার অবাধ্য চোখ দুটো স্হির হয়ে রইল আয়াজের উদম বুকের দিকে। আয়াজ ক্রুর হাসলো। এগিয়ে এসে তোয়ালে প্রিয়তার দিকে ছুড়ে দিল। শুধাল,
‘তাকিয়ে না থেকে পতি সেবা করুণ। বেহেস্তে যাওয়ার কতশত পথ দেখেছেন? তবুও আপনারা মেয়েজাতি আমাদের স্বমীদের মূল্য দিলেন না। কবে বুঝবেন বলুনতো!’
শেষের কথাটা খানিকটা আফসোস নিয়ে বলল আয়াজ। প্রিয়তা কথা বাড়ালো না। তার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এখন জবাব দেওয়া মানেই ঘুমের গলায় ফাঁস পড়ানো। যা সে একদমই চায় না। প্রিয়তা আগালো। চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো আয়াজের চুল মুছে দিতে লাগলো।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করতে লেগে পড়েছে প্রিয়তা। নাস্তা সাথে নিয়ে শাশুড়ি মাকে দেখতে যাবে। শাকিলা বেগমের সাথে তার তেমন একটা আলাপ হয়নি। তবুও তার কাছে ভিষণ আপন মনে হয়। কেমন মায়া জাগে। প্রিয়তার একটা মায়ের সখ বহুদিনের। এতদিনে সে একটা মা পেয়েছে। ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে। সেই কবে মা কে হারিয়েছে সে। চেহারাটাও মনে নেই। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে। মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছুই পেল না।
‘দুটো সংবাদ আছে। একটা গুড অন্যটা ব্যাড। কোনটা আগে শুনতে চান?’
প্রিয়তা কপাল কুঁচকে তাকালো। রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চোখ মুখ জুড়ে বিস্তার হাসি। প্রিয়তা আগাগোড়া আয়াজকে অবলোকন করল। সকাল সকাল কোন ড্রামা স্টার্ট করলো আবার? প্রিয়তা পুনরায় রুটি বেলায় নজর দিল। মুখে বলল,
‘যদি সত্যি কিছু বলার থাকে ঝটপট বলে বিদায় হও। হাতে একদমই সময় নেই।’
‘আপনাকে জব করতে হবে না। ছেড়ে দিন।’
প্রিয়তার হাত থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো। ছেলেটার নির্ঘাত মাথা খারাপ হয়েছে। পরক্ষণেই হেসে দিয়ে বলল,
‘জব ছাড়লে চলব কি দিয়ে পিচ্চিছেলে?’
আয়াজ রাগ করলো না। হাসি মুখে প্রিয়তার পেছনে এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে হাত গলিয়ে মাজা আঁকড়ে ধরলো। প্রিয়তার নরম কাঁধে থুতনি রেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,
‘একটা জব পেয়েছি প্রিয়তা। একটু কষ্টের। কিন্তু মাস শেষে যা পাব তা দিয়ে খুব সুন্দর করে হয়ে যাবে। দু তিনমাস এভাবে চলি। তত দিনে নাহয় একটা ভালো জব খুজে নিব।’
প্রিয়তা মুচকি হাসলো। উত্তর করলো না। কিছু কিছু সময় উত্তর না দেওয়াই ভালো। পরে নাহয় বুঝিয়ে নিবে।
‘ব্যাড নিউসটা কি ছিলো?’
আয়াজ প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়ালে হেলান দিল। ভিষণ রকম মন খারাপ নিয়ে বলল,
‘ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম যেখানে সেখানে জবটা হয়নি।’
প্রিয়তার ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না। সে আগের মতোই রুটি বেলতে বেলতে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘মানুষের অফিসে কাজ করে লাভ নেই আয়াজ। চলো নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাই। নিজেদের এতবড় অফিস থাকতে মানুষের হয়ে কাজ করে কি লাভ?’
আয়াজ ভ্রুকুচু করলো। প্রিয়তাকি জানেনা ও বাড়ি তাদের জন্য নিষিদ্ধ!চাদর গায়ে বাগানের বেঞ্চিতে বসে আছে প্রিয়তা। সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে এসে পড়ছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস আর রোদ মিলে সুন্দর একটা অনুভূতি হচ্ছে।
‘ভাবী ক্রিকেট খেলবেন?’
আয়ান ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। খেলার প্রস্তুতি নিয়েই তবে এসেছে। প্রিয়তা ঘুরৈ বসলো। হাসি মুখে বলল,
‘তো দেবর সকাল সকাল ব্যাট হাতে যে! চাচিমা বুঝি ঘুম?’
আয়ান মাথা দুলিয়ে হাসলো।
‘মা ঘুম বলেই আমি এখানে। নয়তো এতক্ষণে স্কুলের দ্বিতীয় তলির কর্ণারের রুমটার শেষ বেঞ্চে নাক টেনে ঘুমাতে হতো।’
কথা শেষে আবারো হাসলো আয়ান। প্রিয়তা আকাশ সমান বিষ্ময় নিয়ে বলল,
‘সে কি কথা! স্কুল বুঝি ঘুমানোর জায়গা?’
আয়ানের মুখ ভাব পরিবর্তন হলো না। ব্যাট দিয়ে ছয় মারার মতো অঙ্গভঙ্গি করে বলল,
‘সবার জন্য ওটা পড়াশোনার জায়গা হলেও আমার জন্য একান্তই ঘুমানোর জায়গা। ওখানে তো আর মা নেই যে আমাকে ঘুমাতে দেখলেই ধমকে উঠবে।’
বলেই হেসে ফেলল আয়ান। প্রিয়তাও ফিক করে হাসলো। ছেলেটা ভিষণ চঞ্চল। ওর চঞ্চলতা ট্রেনের গতিকেও হার মানাবে। মনের দিক থেকেও ভিষণ ভালো। কত সহজেই প্রিয়তাকে আপন করে নিয়েছে। কোনো কথা শেয়ার করতে দ্বিধা নেই যেন। প্রিয়তা এ বাড়িতে এসেছে এক মাস হয়েছে। তরিকুল সাহেব নিজে গিয়ে তার হাত ধরে অনুরোধ করেছিল ফিরে আসার জন্য। সে আর না করে কিভাবে? বাবার মতো মানুষটার চোখের পানি তার হৃদয়কে শিথিল করে দিয়েছিল। তার পরদিনই সব কিছু নিয়ে ফিরে এসেছিল এ বাড়িতে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকেই প্রিয়তার ভিষণ রকম পছন্দ হয়।
প্রিয়তার আজকাল সময় কাটতে চায়না। জবটা ছেড়ে দিয়েছে সে। ওদিকে নজর দিতে গেলে সংসারের প্রতি উদাসীনতা চলে আসে। প্রিয়তা তা চায় না। সে তার মন প্রাণ উজাড় করে দিতে চায় সংসারে। রোজ সকালে আয়াজের জন্য টিফিন রেডি করে দেওয়া তার খুব পছন্দের কাজের মধ্যে একটি।
‘প্রিয় আমার খাবার রেডি? লেইট হচ্ছে তো!’
আয়াজ হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে রান্নাঘরের সামনে এসে দাড়িয়েছে। প্রিয়তা ঝটপট আয়াজের জন্য টিফিন বাটিতে তুলে দিচ্ছে। শাকিলা বেগম প্লেটে পরাটা আর ভাজি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
‘নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছ?’
‘নাস্তার সময় নেই মা। বাবা বকবেন লেইট হলে।’
‘আমি তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। নাও হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি। সময় লাগবে না বেশি।’
আয়াজ হা করলো। শাকিলা বেগম যত্ন নিয়ে ছেলের গালে খাবার তুলে দিতে লাগল। প্রিয়তা তা দেখে মুচকি হাসলো। মায়ের যত্ন বুঝি এমন মধুর হয়!
‘কাকিমা তুমি তোমার অতবড় ছেলেকে এখনো গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছ। আর আমি ছোট হওয়া সত্ত্বেও মা আমাকে মাছের কাটা বেছে দিতে চায়না।’
ভিষণ উদাস হাওয়ার ভান করল আয়ান। ছেলেটা মাছের কাটা ভয় পায়। অদ্ভুত হলেও সত্যি। মাছের কাটা বাছার ভয়ে সে মাছ খেতে নারাজ। ছোট চাচি ওর ভয় দূর করতেই কাটা বেছে দিতে চায়না। দুনিয়াতে এত অদ্ভুত অদ্ভুত ভয়ঙ্কর জিনিস থাকতে মাছের কাটাকেই কেন ভয় পেতে হবে?
এর মাঝেই প্রিয়তা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল। আয়াজের খাওয়া শেষ হতে এক প্রকার দৌড়ে বের হয়ে গেল সে।
‘দেবরকে উদাস কেন লাগছে?’
‘ভাবছি জেলেনি বিয়ে করবো। যে মাছ ধরতে পারে সে নিশ্চই মাছ বাছতেও পারবে কি বলেন ভাবী?’
প্রিয়তা বিজ্ঞদের মত মাথা নাড়াল। সম্মতি জানিয়ে বলল,
‘সে তো অবশ্যই।’
‘তাহলে আমার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে ফেলেন ভাবী। অনেকদিন হলো সরষে ইলিশ খাইনা।’
আয়ানের কন্ঠে উচ্ছাস। শাকিলা ধমক দিলেন।
‘খাবার টেবিলে এত কথা কেন আয়ান? তোমার মা কোথায়? এখনো ওঠেনি?’
এর মাঝেই তিনি নেমে এলেন। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
‘রাতে ঘুম হয়নি ভাবী। মাজাটা যা ব্যাথা। সকালের দিকে একটু চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। এই একটু দেরি হলো।’
মায়ের কথায় আয়ান ফোড়ন কাটলো।
‘হ্যাঁ মা এজন্যই রাত এগারোটার পর তোমার রুমের পাশ থেকে কেউ হাঁটতে পারেনা। গরিলার নাক ডাকার মতো অদ্ভূত সব শব্দ ভেসে আসে।’
আয়াজের কথায় প্রিয়তা মজা পেল। ঠোঁট টিপে হাসলো। শাকিলা বেগম না হাসলেও তার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে তিনিও হাসি চাপিয়ে রেখেছেন। কিন্তু ছোট চাচি তেতে উঠলেন।
‘তুমি বেশি বকবক করছো আজকাল আয়ান। এমন হলে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিব।’
অবস্থা বেগতিক দেখে শাকিলা বেগম কথার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এভাবেই তিনি আয়ানকে বাঘের কবল থেকে বাঁচিয়ে নিলেন।
চোখের পলকে সময়গুলো কিভাবে যেন পার হয়ে যেতে লাগলো। দিন থেকে মাস মাস গড়িয়ে বছর হতে চলল। প্রিয়তাকে যেন আয়াজ সুখের চাদরে আগলে রেখেছে। কোন দুঃখ যেন তাকে ছুঁতেই পায় না। এত এত সুখের মাঝে হঠাৎ করেই একটা খারাপ সংবাদ এসে প্রিয়তাকে মুচরে দিল। ধুপ করেই যেন ভেঙে গেল তার পাশের সুখের দেয়াল। তার মামা মারা গিয়েছে। এমন একটা সংবাদের জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এতটা বছর ধরে যে মানুষটা বটগাছের মতো ছায়া হয়ে ছিল তার মাথার উপর সেই মানুষটার মৃত্যু সংবাদ শোনার মতো ভয়ংকর আর কি বা হতে পারে। প্রিয়তার দুনিয়াটা যেন সেখানেই থমকে গিয়েছিল। তার গগণবিদারী আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো বাড়ির আনাচে কানাচেতে। কেঁপে উঠলো যেন গহিনে থাকা ক্ষুদে প্রাণগুলোও। তার কান্না আর আহাজারি সহ্য করতে না পেরে শাকিলা বেগম সমেত আয়াজ প্রিয়তাকে নিয়ে প্রিয়তার মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পুরো পথটাই প্রিয়তা কেঁদে কেঁদে চললো। কোনো রকম শান্তনা বাণি পারেনি তার এ কান্নাকে থামাতে।
বাড়ি ভর্তি লোক। তবে বাড়িতে কোনো আমেজ নেই। নেই কোনো আনন্দ। সকলে নিরব থেকে তাদের দুঃখ প্রকাশ করছে। ভীর ঠেলে প্রিয়তাকে নিয়ে এগিয়ে গেল আয়াজ। এতটুকু পথ আসতে আসতেই মেয়েটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। সুজলা এলোচুলে বিদ্ধস্ত হয়ে বসার রুমে বসে আছে। তাকে ঘিরে ধরে আছে আর ছয় কি সাতজন মহিলা। পাশেই তুলি পানির জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা কেমন পাথরের মতো হয়ে গেছে। এত ভীরে কেউ হয়তো মেয়েটার দিকে নজর দিতেই সময় পায়নি। রত্নাকে কোথাও দেখা গেল না। প্রিয়তাকে দেখা মাত্রই সুজলা চিৎকার করে উঠলো।
‘এই বান্দির ঝি! তুই কেন আসছিস? বের হ আমার বাড়ি থেকে। এই মুহূর্তে বের হ।’
সুজলা এমন দিনেও এই আচরণ করবে এমনটা বুঝতে পারেনি আয়াজ। শাকিলা বেগম তব্দা খেয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি এসবের কিছুই বুঝতে পারছেন না। এর মাঝে প্রিয়তা কেঁদে উঠলো। সুজলার পা জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো।
‘মামি এভাবে বলো না। আমি থাকতে আসিনি মামি। মামাকে একবার দেখেই চলে যাব। আমি আর কখনো আসব না বিশ্বাস কর।’
প্রিয়তার এই আহাজারিতে পাথর নরম হলেও সুজলা নরম হলো না। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা কখনো সুধরায় না। কোনো পরিস্থিতি পারে না তাদের জঘন্য রূপ থেকে তাদের বের করে আনতে। সুজলাও তাদের মধ্যে একজন। আয়াজ এমন জঘন্য মহিলার সাথে তর্কে যেতে চায়না। তাই এক প্রকার জোর করেই প্রিয়তাকে সাথে নিয়ে বের হয়ে আসে। পৃথিবীতে যদি খারাপ মানুষের কাউন্টিং করা হয় তবে এই মহিলাই হবে প্রথম। এমনটাই ধারণা আয়াজের।
ফিরে আসার পর গুমট হয়ে পড়েছিল প্রিয়তা। আয়াজ শত চেষ্টা করেও প্রিয়তার সাথে কথা বলতে পারেনি। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিল। থকনা কিছুটা সময় নিজের মতো!
মন খারাপের স্থায়িত্ব হলো সপ্তাহ খানেক। আজ সপ্তাহ খানেক বাদে প্রিয়তা রান্নাঘরে এসেছে শাকিলা বেগমের সাথে রান্না করতে। বউমার এ কাজে শাকিলা ভিষণ খুশি হলো। এ কয়দিন মেয়েটা রুম বন্ধ করে ছিল তাতে যেন বাড়িটাও আঁধারে তলিয়ে ছিল।
‘মা বাবা আজ বাসায় আছেন?’
‘হ্যা। আজ অফিসে যাবেন না শুনলাম।’
প্রিয়তা সুন্দর করে এক কাপ লাল চা বানালো। তার হাতের চা তরিকুল সাহেবের পছন্দ। এ সময় তিনি বাড়িতে থাকলে
স্টাডি রুমেই থাকেন। তাই প্রিয়তা সেদিকেই পা বাড়ালো।
‘বাবা আসবো?’
তরিকুল সাহেব বই থেকে চোখ সরিয়ে তাকালেন। প্রিয়তাকে দেখা মাত্র তার মুখে হাসি ফুটলো। হেসে বলল,
‘মা যে! আসো আসো। কতদিন বাদে মুখখানা দেখলাম।’
প্রিয়তা মুচকি হাসলো। চা এগিয়ে দিতেই তিনি চায়ের কাপ নিয়ে তৃপ্তি নিয়ে চুমুক বসালেন। উৎসাহ নিয়ে বললেন,
‘জানো মা তোমার হাতের চায়ের স্বাদ একদম আমার আম্মার বানানো চায়ের মতো। আলাদা একটা তৃপ্তি আছে।’
প্রিয়তা এ কথা জানে। যতবার প্রিয়তা তাকে চা দেয় প্রত্যেকবার তরিকুল সাহেব অতি আগ্রহ নিয়ে তাকে এই একই কথা শোনায়। প্রিয়তার এতে বিরক্ত লাগে না। বিষয়টা তার খুব অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগে।
সকাল সকাল প্রিয়তার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে এলো। মাথাটা ধরে গেছে। উঠে বসে গরম চোখে আয়াজের দিকে তাকালো।
‘কতবার না করেছি এত সাউন্ড দিয়ে টিভি না দেখতে? আমাকে কি একটু ঘুমাতেও দিবে না?’
আয়াজ করুণ চোখে তাকালো। তার কোলে বসে আছে তিন বছর বয়সী আজরা। যে কর্টুন দেখে খিলখিল করে হাসছে। প্রিয়তা কি বলবে খুঁজে পেল না। এতদিন শুধু আয়াজ ছিল। এখনতো তাকে জালানোল জন্য আরো একজন আছেন। এরা বাপ মেয়ে মিলে তার জীবনটা নিমপাতা করে তুলছে।
‘আপনি আমাদের শত্রু কেন ভাবছেন বউ? আমরা তো একটু কার্টুন দেখছি মাত্র। তাই না মাম্মা?’
মাথা দুলালো আজরা। ছোট ছোট করে বলল,
‘মাম্মা শত্তু।’
আয়াজ ফিক করে হেসে ফেলল। গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘চলো আমরা ঘুরে আসি। মাম্মা এখনি নয়তো পিটুনি দিবে।’
যাওয়ার পূর্বে আয়াজ প্রিয়তার উদ্দেশ্য একটা কিস ছুড়ে দিল। যা দেখা মাত্র প্রিয়তা চোখ গরম করে তাকালো। কিন্তু ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মেয়ে সহ আয়াজ বের হয়ে গেল। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে হাসলো। এখন আর তার ঘুম হবে না।
আজরা দেখতে অনেকটা আয়াজের মতো হয়েছে। একদম বাপকা বেটি। স্বভাব ও বাপের মতো। বদ মেজাজি একরুখে ধরণের। এই ছোট বয়সেই মেয়ের এত জেদ বড় হলে যে কি হবে! মায়ের থেকে বাপের সাথেই তার ভাব বেশি। প্রিয়তার মাঝেমধ্যে মনে হয় সে ভুল করে এই দুজনের দুনিয়ায় চলে এসেছে। কিন্তু মেয়েটা তার ভিষণ মিষ্টি। সাথে মেয়ের বাপটাও। দুজনকে দেখলে কেবল দেখতেই মন চায়। এত আদুরে কেন তার প্রিয় মানুষগুলো!