শূন্যতা (২য় পাট)

আরশান মাথা নিচুকরে ওর বাবার সামনে বসে আছে।মাতলামোটা এখন ছেড়ে গেছে। মি.রহমান আরশানের এই অবনতিতে বেশ চটে আছেন। কর্কশ গলায় মি.রহমান বললেন

photo of multicolored abstract painting

শূন্যতা (২য় পাট)

-তোমাকে আমার ছেলে পরিচয় দিতেও লজ্জা হচ্ছে আরশান। তুমি শুধু মাতালই হও নি। মাতাল হয়ে একটা মেয়েকে হ্যারেস করেছো। ছি!

আরশান এখনো মাথা নিচু করে আছে।

মি.রহমান আবার বললেন,

-এসব কথা আমার সৃজার মুখে শুনতে হয়, যে মেয়েটার সাথে আর কিছুদিন পর তোমার বিয়ে সেই মেয়ে আমাকে ফোনে জানায় তুমি নেশার ঘোরে অন্য মেয়েকে। ছি ছি ছি আরশান।

-বাবা ও অন্তি(আরশান মাথা নিচু করেই বললো)

-কে অন্তি? (মি.রহমান প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন আরশানের দিকে)

নুন বললো

-বাবা ভাইয়া যে মেয়ের সাথে মানে ( একটু কাচুমাচু করে বললো) ওই মেয়েটা অন্তি আপু ছিলো।

মি.রহমান রাগান্বিত চোখে আরশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-ছি ছি! আরশান তোমার ছোট বোনও এসব জানে।ছি!লাজ লজ্জা সব শেষ করে ফেলেছো নাকি? কিন্তু অন্তি টা কে, কোন অন্তি?

কড়া গলায় বললেন

-অয়ন্তি নয়তো? যার জন্য তোমার এতো অবনতি।ওই মেয়েটা নয়তো? কি চায় ও? চলে তো গেছেই এই ছেলেটাকে নোংরা বনিয়ে গেছে। আরশান জবাব দাও ওই মেয়েটাই তো?

আরশান কিছু না বললেও নুন অন্তির নামে যেনো কোনো কথা সহ্য করতে পারছিলো না।

নুন বললো,

-বাবা অন্তি আপু মোটেও অমন মেয়ে না। ও তো ভইয়াকে এভোয়েডই করছিলো।

মি.রহমান নুনের কথায় আরো যেনো রেগে যেয়ে বললেন,

-নুন আমি চাইনা তুমি এর মাঝে কথা বলো। চুপচাপ নিজের রুমে যাও। আর ভবিষ্যতেও তুমি এই কথার মাঝে নিজেকে জড়াবে না।

নুন তার বাবার এমন আচরনে কিছুটা ঘাবরে যেয়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।

আরশানের চোখটা খুব জ্বালা করছে। আজ ওর বাড়াবাড়ির জন্যই অন্তিকে ওর বাবা এতোগুলো কথা শুনাতে পারলো। এটা ভাবতেই আরশানের আরও বেশি খারাপ লাগছে। আজ অন্তির তো কোনো দোষ ছিলো না। অন্তিতো নতুন করে আরশানের দিকে হাত বাড়াই নি। পাগলামি যা করার আরশান করেছে।

মি.রহমান আরশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-আরশান কিছু জিনিস পেয়ে গেলে জীবনের উত্থান পতনটা অনুভব করা যায় না। বরং না পাওয়া জিনিস গুলো জীবনকে পরিবর্তন করে, কিছু উইশ রেখে যায়। ভালো অথবা খারাপ দুটোর একটি গ্রহন করতে হয় তখন। আশাকরি তুমি ভালোটাই গ্রহন করবে।

আরশান চোখ বন্ধকরে মনে মনে বললো

-আমাকে ও কোনো উইশ দিয়ে যায় নি, তবে একা ছেড়ে গেছে বাবা।

অনেক রাত হলেও ঠিক ভাবে অন্তির ঘুম আসছে না। প্রিয়া অনেক বার নুন এর বেপারে কথা বলতে চাইলেও অন্তির আগ্রহ না পেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে।

অন্তি বারান্দায় তাকিয়ে আছে। কাল রাতেও এই পথে একজন লোক পাগলের মতো পায়চারি করেছে। অথচ আজ লোকটা নেই। পরপারে চলে গেছে। অন্তি কিছুক্ষন শূন্যে তাকিয়ে থাকলো। পৃথিবীটা কতো অদ্ভুদ।

আরশানের পাগলামিগুলাও অন্তির ভেতর তুলপার করছে। আরশান এভাবে পাগলামি করলে অন্তি নিজেকে কিভাবে ধরে রাখবে। অন্তি যে কিছুতেই আরশানকে বোঝাতে পারছে না। কতোদিন পর ছেলেটার স্পর্শ পেলো অন্তি, ভাবতেই অন্তির খুব জোড় কান্না পাচ্ছে।

একটা সময় এমন হতো যে আরশান ক্লাশে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে একেরপর এক মেসেজ করে যেতো অন্তিকে। আর ক্লাশ শেষ হলে একছুটে বাসা আর বাসায় এসে জামা কাপর না পালটেই অন্তির সাথে কথা বলতে শুরু করতো। তখন অন্তির দিনগুলো ছিলো “শানময়” আর শানের দিনগুলো অন্তিতে মত্ত। দেখা হলেই আরশান অন্তির হাতটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে হাসি মুখে বলতো এইখানটায় তুমি থাকো, খুব দামী জায়গায়।

এখন সবই অতীত।

অন্তি মনে মনে প্রতিঞ্জা করলো “ওর আর আরশানের জন্য পিছুটান রাখলে চলবে না। যা কোনোদিন হবার নয় তার জন্য অন্তি আর ভাববে না। ওকে এগিয়ে যেতে হবে। আর আরশানের সামনে নিজেকে অনেক স্ট্রং রাখতে হবে। নিজের জন্য না হোক আরশানের ভালোর জন্য এটা খুব জরুরি”।

অন্তির এতো ভাবনার মাঝে কখন যে ওর মা ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে অন্তির সে খেয়ালই নেই। আর হঠাৎ ই অন্তির মা ওর কাধে হাত রাখতেই অন্তি চমকে উঠে ওর মার দিকে তাকালো।

অন্তির মা বললেন

-কিছু ভাবছো?

-না আম্মু। আব্বু কি চট্টগ্রাম পৌঁছেছে?

-না এতো তারাতারি কি আর পৌছাবে, যেতে যেতে সকাল হবে।

-ওহ।

-অন্তি তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

অন্তি ওর মার কথায় কিছুটা বিচলিতো হয়ে গেলো। মা কোনো ভাবে আরশানের আজকের ঘটনাটা যেনো গেলো নাতো? আর মিসেস হাসনাতের চেহারাও কিছুটা সিরিয়াস হয়ে আছে। অন্তি তবুও মুখে একটা হাসি ধরে রেখেই বললো,

-জ্বী মা বলো।

-অন্তি তুমি ইন্টারে একটা বছর নষ্ট করেছো অসুস্থ থেকে। আর এর পর এডমিশন এও কোনো ভার্সিটিতে চান্স হলো না। তারমানে দুইটা বছর নষ্ট হলো তোমার জীবন থেকে। অন্তি তোমার বাবা বা আমি আমরা কেউই চাইনা তুমি আরও সময় নষ্ট করো। এখন যদি সেকেন্ড টাইম এডমিশনের আশায় থাকো আর পরের বছরও কিছু না হয় তখন আরও একটা বছর নষ্ট হবে। তাই তোমার বাবা আর আমি ডিসিশন নিয়েছি তোমাকে প্রিয়ার সাথে একই প্রাইভেট ভার্সিটিতে এডমিট করে দিবো। প্রিয়াও এই মাসেই ভর্তি হবে

-আম্মু তোমরা যা ভালো মনে করো তাই হবে। (অন্তি খুব নরম গলায় কথাটা বললো)

মিসেস হাসনাত অন্তি হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন।

-অন্তি পড়ালেখা জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন জিনিস।এইটা ছাড়া জীবনে কিছুই করতে পারবে না। আমি চাই তুমি নিজ পায়ে দাড়াও। নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যাও। অন্তি তুমি যে ভুলটা করছো তা নাহয় ছোট বয়সের ভুল বলেই আমি আর তোমার বাবা ক্ষমা করে দিয়েছি। আশা করি এখন এসব আর মনে রাখো নি। ভুল যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন নতুন করে সব শুরু করো। আমরা আবার ঢাকা শিফট করছি। তোমার আর রুশ্যর পরালেখার জন্য।

আর একটা কথা অন্তি, এভাবে ঘরকুনো হয়ে থেকো না। বি নরমাল। আমাদের প্রথম সন্তান তুমি। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন।

অন্তি এখনও চুপচাপ ওর মার কথা গুলো শুনছে। অনেকদিন পর মিসেস হাসনাত মন খুলে মেয়ের সাথে দুটো কথা বললেন।

মিসেস হাসনাত আবার বললেন,

-অন্তি তুমি কেমন যেনো পেনপেনে হয়ে গেছো। চুলগুলো ঠিক একদম শেইপ ছাড়া হয়ে গেছে। বিয়ের ঝামেলা শেষ হলেই তোমাকে নিয়ে পার্লারে যাবো। আর হ্যা তোমার বাবা বলেছেন তোমায় মেডিটেশন ক্লাসে এডমিট করাতে। আর এতো কিছুর মাঝেও যদি তোমার রুটিনে একটু সময় থাকে তবে জিম এ ভর্তি হবে। তোমার নিজেকে গড়ে তুলতে হবে সবদিক থেকে, আরও চতুর হতে হবে অন্তি।

অন্তি ওর মার দিকে তাকিয়ে বললো

-আম্মু আমি কি সব পেরে উঠবো?

-তোমাকে পারতে হবে অন্তি। পড়ালেখার পাশাপাশি সবকিছুতেই পারদর্শী না হও কিন্তু অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আমি আর তোমার বাবার অবর্তমানেও যেনো তুমি তোমার ঢাল হতে পারো অন্তি। এভাবে মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকলে কিচ্ছু হবে না জীবনে। নতুন নতুন চেলেন্জ নিতে হবে তোমাকে।

অন্তি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওর মায়ের কথা গুলো শুনছে

মিসেস আহসান আবার বললেন

-রুশ্য যেমন আমাদের ছেলে তুমিও আমাদের মেয়ে। আমাদের দুটো আস্থা, ভরসা, স্বপ্ন। ভুল পথে যেও না মা।

মিসেস হাসনাত অন্তিকে কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

অন্তি এবার আরও দৃঢ় মনে প্রতিঞ্জা করলো যে, নিজের জন্য না হোক বাবা মার জন্য হলেও সব পিছুটান ও ছাড়িয়ে যাবে।

পিহুকে পাশে নিয়ে অন্তি ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লো

ঘরে মোটামোটি লাউডে মিক্সটেপের গান চলছে

“পাশাপাশি বসে একসাথে দেখা

একসাথে নয় আসলে যে একা

তোমার আমার ফারাকের নয়া ফন্দি

আহা-হা-হা আহা আহা-হা-হা

আহা আহা-হা-হা………..

(Na Jaane Koi Kaisi Hai Yeh Zindagaani Zindgaani Hamari Adhuri Kahani)… (2) “

চোখ বন্ধকরে বিছানার এককোনায় জড়সর হয়ে বসে আছে আরসান। মস্তিষ্কের মাঝে গানের লিরিক গুলো আনাগোনা করছে। একটা টু-কুয়াটার প্যান্ট পরে খালিগায়ে বসে আছে। চুলগুলো পুরো এলো মেলো।

এর মাঝেই কড়া পারফিউমের স্মেলই আরশানকে জানান দিলো ঘরে অন্যকেউ প্রবেশ করেছে।

আরশান চোখ খুলে বিরক্তি নিয়ে বললো,

-কি চাই?

-সৃজার এখন তোমাকে চাই।

-তোকে বলেছিনা আমার রুমে অনুমতি ছাড়া আসবি না।

-ওহ শান। কয়েকদিন পর আমাদের বিয়ে। এখনও অনুমতি নিতে হবে?

-জাস্ট সাট আপ। তোকে আগেও বলেছি ভুলেও আমায় শান ডাকবি না। আমার নাম আরশান।

-অন্য কারো মুখে শুনতে বুঝি ভালো লাগে?

-ইউ নো হুয়াট, তোর সাথে কথা বলাই বেকার।

এটুকু বলেই শান বিছানা থেকে উঠে লেপটপের সুইচ অফ করে কাধে টাওয়েল নিতেই সৃজা শানের হাত ধরলো।

শান রাগি চোখে তাকিয়ে বললো

-কি চাই তোর?

-আপাদত গুড মর্নিং কিস্সি।

-হুয়াট?

সৃজা আরশানের অনুমতির অপেক্ষা না করেই আরশানের গলা জড়িয়ে ধরে পা উচু করে আরশানের ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যেতেই আরশান নিজেই নিজের দু ঠোট চেপে মাথাটা একটু পিছিয়ে নিয়ে সৃজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।

এখন যেনো আরশানের চোখে মুখে রাগ ভেসে উঠছে। রাগি গলায় বললো,

-তোকে কতোবার বলছি আমার কাছে ঘেসবি না। কিস তো অনেক দূরের চিন্তা, আমাকে টাচও করবি না।

সৃজা মুখ বাকিয়ে বললো,

-আমার কিস কেনো ভালো লাগবে, কাল রাতে তো অন্য মেয়েকে ঠিকিই

-সৃজা জাস্ট সাট আপ। ওর সাথে কখনও নিজেকে তুলনা করবি না। আর তোর সাহস হলো কি করে এসব বাবাকে বলতে?

-বলবো না? আমার বর অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরবে আমি বলবো না?

-না। কজ আমি তোর বর না। আর হ্যা তোকে একটা সাজেশন দেই তুই কোনো এক ছেলেকে পচ্ছন্দ কর। আমি নিজে তোদের বিয়ে দিবে। আমার লাইফ থেকে সর। আর চোখের সামনে থেকেও।

সৃজা একটা হাসি দিয়ে বললো

-তোমাকে জালাতে আমার ভালো লাগে। আমার থাকাটাতো জরুরি বলো? আর কাউকে পচ্ছন্দ হলেই কি তোমার লাইফ থেকে সরে যাওয়া এতো সহজ?

স্টুপিড।

বলেই আরশান রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

বিয়ে বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম। একই বাড়িতে বর বউ। এই জন্য অবশ্য দুই পক্ষের মানুষ এ পুরো সাজানো মাঠটা গিজ গিজ করছে।

আরশান খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্টেজের কাছে দাড়িয়ে আছে। আর তার হাত ধরে আছে সৃজা। যে কেউ দেখলেই বলবে খুব সুইট কাপল এরা। ব্লাক ব্লেজার, হোয়াইট টিশার্ট, হোয়াইট স্নিকার্স আর চুল গুলো জেলদিয়ে সেট করা একদম হিরোর মতো লাগছে আরশানকে। যদিও আরশানের বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ছিলো না। তবুও নিজের চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে না আসলে বিষয়টা খুবই বাজে দেখায়।

আশেপাশের সবার চোখ আটকে আছে বর বউ এর দিকেই। আর এর পরই সবাই আরশান আর সৃজার দিকে এটেনশন দিচ্ছে। তবে আরশান সানগ্লাসের আরালে তাকিয়ে আছে অন্তির দিকে।

খুব একটা সাজেনি মেয়েটা। রেড প্লেন শাড়ির সাথে ডিজাইনার নেট ব্লাউজ পরেছে আর ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। কোলে একটা ছোট্ট বিড়াল বাচ্চা। আরশান আর অন্তির দিকে মনোজোগ দিলো না। কখনও চোখাচোখি হচ্ছে তো কখনও সামনাসামনি দেখা হচ্ছে।

না কেউ কারোদিকে তাকাচ্ছে না কেউ কাউকে ইম্পর্টেন্ট দিচ্ছে। বরং দুজনই এমন একটা ভাব করছে যেনো কেউ কাওকে চিনেই না।

নুন দুজনকেই দেখছে তখন থেকে। ওর চোখে আজ যেনো মনে হচ্ছে একদম একজন আরেকজনের এক্স। কাল বা পরশুও দুজনের মাঝে যে আবেগটা দেখেছিলো তা যেনো আজ একদম নেই।

পুনমের বিয়ের ঝামেলা শেষ হতে না হতেই অন্তির জীবনে নতুন যাত্রা শুরু হয়ে গেলো।

বৌভাতের পরের দিন সকালে নাস্তা করেই অন্তি ওর মার সাথে ছুটে গেলো পার্লারে। অন্তির মুখটা মোটামুটি ডিম্বাকৃতির, যেকোনো হেয়ার কাট ই যেনো ওর মুখে মানান সই। বেঙস লেয়ার কাটার পর চুলে বারগেন্ডি আর মেহগনি শেডের মাঝামাঝি কালার করাতে চাইলে অন্তি ওর মাকে না করলো ও চুলে কালার করাবে না।অন্তি নিজের একদম প্রাকৃতিকতা হারাতে চায় না।

অনেক দিন পর অন্তি হয়তো নিজের মুখে কোন কিছুতে না করলো। অন্তির মাও আর এবারে আগ্রহ দেখলেন না। কমপ্লিট হওয়ার পর যখন অন্তি আয়নায় নিজেকে দেখলো বিষয় টা অন্তির কাছে কেমন যেনো ভয়ংকর রকমের হার্টবিট মিস করার অনুভূতি দিলো। লম্বা চুল গুলো কোমরে উঠে এসেছে। অন্তি চোখ বন্ধ করে ভাবলো”এই জায়গাটা থেকেই ওর একদম বদলে যাওয়া শুরু।”

এরপর মেডিটেশনের ক্লাসে এডমিট হতে গেলেও এ মাসের জন্য কোনো ব্যাচ খালি পেলো না।অন্তি যখন মেডিটেশন ট্রেনারের মুখে কথটা শুনলো যে, কোনো ব্যাচ এ আসন খালি নেই অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভাবলো এতো মানুষের মনে অশান্তি? এতো জন মন শান্ত করতে মেডিটেশন করতে আসে? অন্তি ওর মার দিকে তাকিয়ে বললো, এতো মানুষ অশান্তি তে আছে মা?

অন্তির মা অন্তির কথায় হেসে দিয়ে জবাব দিলেন

-অন্তি মেডিটেশন শুধু মন শান্ত করার জন্য নয়। মন ফ্রেশ কারার জন্যও অনেকে করে এমনকি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রন করার জন্যও। কাজে মনোযোগ বাড়াতেও অনেকে মেডিটেশন করে।

আগামী মাসের জন্য কিছুটা এডভান্স করেই অন্তি আর ওর মা চলে আসলো যেনো আসন খালি হতেই অন্তিকে এডমিট করানো হয়।

সারাটা দিন অন্তি আর অন্তির মা খুব ব্যাস্তাতার সাথেই শেষ করলো। নতুন ফ্ল্যাট খোজেছে ওরা। মনের মতো ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য সারাদিন শেষ করলো। দু দিনের মাঝে অন্তিরা নিজেদের নতুন ফ্লাটে শিফট হয়ে গেলো।

অন্তির এখন রেগুলার রুটিন সকালে উঠে রুশ্য আর পিহুকে নিয়ে পার্কে হেটে আসা। এর পর ওইখান থেকে এসেই খবার খেয়ে ক্লাসে যাওয়া। এক মাস এর মাঝেই পুরোদমে ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। ক্লাস শেষে বাসায় এসেও দম নেওয়ার সময় নেই। বিকালে ছুটতে হয়ে জিমে। এতো এতো ব্যাস্ত রুটিনএ অন্তি সারাদিন আরশানকে মনে করতে না পারলেও দিন শেষে রাতের আধারে একা সময়টা বারান্দায় বসে অন্ধকারে শূণ্যে তাকিয়ে থাকে। আরশানের ভূতটা কিছুটা ফিকে হয়েগেছে অন্তির মাথায়। এসব ভুলে থাকাই ভালো। অন্তির বাবার সাথেও এখন সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

অন্তির বাবা অন্তির মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন দেখছেন। মেয়েটা আজকাল একটু চটপটে হয়েছে। আগের মতো ঘরের মাঝে নিজেকে বন্দি রাখেনা বরং নিজের প্রত্যেকদিনকার রুটিনটাকে গুছিয়ে চলতে পারছে। অন্তির বাবা সবথেকে খুশি হলেন অন্তির বারান্দায় করা ফুলের বাগানটা দেখে। পুরো বাগানে কয়েক রংয়ের গোলাপ ফুলের গাছ আর দুটো বেলিফুল গাছ লাগিয়েছে অন্তি। সকাল বিকাল সময় পেলেই গাছের পরিচর্যা করে মেয়েটা।

সেদিন শেষ সেমিষ্টারের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে বাসায় ফেরার পথেই আরশানের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো। ড্রাইভার গাড়িটা গেরেজে নেওয়ার ব্যাবস্থা করলো। রোদের মাঝে অনেকক্ষন দাড়িয়ে থাকার পর মোটামুটি একটা খালি বাস পেয়েছে আরশান।

উঠে গেলো বাসটাতে।

খালি এক সিটে বসতে যেয়ে আরশান খেয়াল করলো একপাশে এক মেয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। পনিটেলের ফাক গলে কিছু কাটা চুল বেড়িয়ে এসেছে। মুখের একপাশটায় কাটা চুল গুলো ছড়িয়ে আছে। চোখে গোল চশমা, ঠোটে হালকা লিপষ্টিক, মুখটা ভালো ভাবে দেখা না গেলেও অারশানের চিনতে ভুল হলো না।

পাশেই একটা ছেলেকে দেখলো অন্তিকে ঘেসার চেষ্টা করছে। আর অন্তি জানালার বাইরে তাকিয়ে যতোটা পারছে নিজেকে সেটে নিচ্ছে এককোনায়। ছেলেটা বার বার অন্তির কোমর বরাবর হাত এগিয়ে নিচ্ছে আবার পিছাচ্ছে।

ছেলেটার তাকানো দেখেই আরশানের যেনো মুহূর্তেই রাগ চরমে উঠে গেলো।

নিজের সিট ছেড়ে আরশান অন্তির সিটের সামনে এসে দাড়ালো। ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো

-এক্সকিউজমি ব্রো।

-আমি? (ছেলেটা)

-হ্যা।

-বলেন।

-আপনি প্লিজ ছিট টা চেন্জ করবেন?

অন্তি এতোক্ষনে পাশে তাকিয়ে দেখলো আরশান দাড়িয়ে আছে। অন্তি মনে মনে সস্থির নিশ্বাস নিলেও আরশান যে ওর জন্য কতো বড় অসস্থি তা ও ভালো করে বুঝতে পারছে। আরশানকে এই সময় এখানে দেখে অন্তির হার্ট খুব ফাস্ট বিট করছে।

ছেলেটা আরশানের দিকে রাগান্বিত হয়ে বললো

-পুরো বাস ফাকা আমার সিট কেন পাল্টাইতে হইবো?

-পুরো বাস ফাকা আপনিও দেখছেন তাহলে এখানেই চিপকে আছেন কেনো?

-আমার ইচ্ছা। খালি ছিট পাইছি বইসি। কোনো সমস্যা?

-হ্যা। আলবাদ সমস্যা। মেয়েটাকে একা ছেড়ে সিট টা ছেড়ে দিন।

-আরে আপনার সমস্যা কি অন্য কোথাও যায়ে বসেন না। আমি এইখানে বসছি ওই মাইয়া তো কোনো কমপ্লেন করে নাই। আপনার সমস্যা কি?

চাপাচাপি শুনে বাসে থাকা যে কয়েকজন ছিলো সবাই আরশান আর লোকটার দিকে তাকালো।

আরশান এখন যেনো আর রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। লোকটার কলার ধরে বললো,

-ওর কমপ্লেন করতে হবে কেনো? তুই যে এতোক্ষন ওকে ঘেসে বসার চেষ্টা করছিলি তা তো আমি দেখেছি। ভালোই ভালোই উঠে যা।

-আজব তো মাইয়ার কোনো সমস্যা নাই। আপনে এতো পেরা নেন কেন। কই থেকে আইয়ে এমন জবরদস্তি লাগাইছেন?

আরশান রাগি চোখে অন্তির দিকে তাকিয়ে বললো

-তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না অন্তি? এই লোকটার আচরনে কি একটুও বিব্রত নও তুমি?

অন্তি ভয়ে ভয়ে হ্যা সূচক মাথা নারিয়ে লোকটাকে বললো

-ভাইয়া আপনি সিট টা ছেড়ে দিন।

আরশান এখনও রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা বললো

-তো আমি উইঠা পরলে এই লোকরে বসাইবেন?

আরশান বললো

-ওইটা তোর ভাবতে হবে না, উঠ।

চাপাচাপি আরও বাড়তে থাকলে বাস হেল্পার এসে লোকটাকে সিট থেকে রিকুয়েষ্ট করে তুলে নিয়ে সামনের সাড়িতে বসালো।

আরশান অন্তির সাথে বসতে যাবে এমন সময় পাশের সাড়ি থেকে এক মেয়ে আরশানকে ডাক দিলো

-হেই আরশান।

আরশান তাকিয়ে হাই দিলো।

মেয়েটা অন্তিকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে আরশানকে বললো

-নতুন প্রজেক্ট?

-না। ফাস্ট এন্ড লাস্ট প্রজেক্ট।

মেয়েটা আর কথা বাড়নোর আগেই আরশান অন্তির পাশে বসে গেলো।

অন্তি এখনও হা করে আরশানের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তির তাকানো দেখেই আরশান বললো

-হেই এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি উগান্ডায় থাকি। এইমাত্র উগান্ডা থেকে লেন্ড করলাম। এখানে কিভাবে আসলাম? ভিসা পাসপোর্ট ফ্লাইট মেনেজ হলো কিভাবে? অন্তি বি নরমাল আমি এই শহরেই থাকি। হুট হাট দেখা হতেই পারে।

অন্তি কিছু না বলে এখনো আরশানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আরশান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো

-মিস অয়ন্তি হাসনাত। এমন ফাকা বাসে কোনো মেয়ের পাশে না বসে ছেলেকে পাশে বসতে দিলে কতো বিপদ হতে পারে জানো? আর একা একা তোমার বাবা মা তোমায় ছেড়ে দিলো? আহা কেয়ার কি কমে গেছে

-আজ প্রিয়া ক্লাসে আসে নি তাই একা যেতে হচ্ছে

-আর এই মেয়ে যতো রাগ তো আমার উপর দেখাতে পারো। এমন বখাটেদের প্রতিবাদ করতে পারো না?আমি তো নিজে এসেই দেখলাম ওই ছেলে তোমার কোমরে হাত রাখার চেষ্টা করছিলো। আর বাজে নজরে তাকিয়ে ছিলো। অন্তি নিজেকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা না করে গুটিয়ে থাকলে কি হবে?

অন্তি মাথা নিচু করে জবাব দিলো

-না। আমি এমন সিচুয়েশনে কখনও পরি নি। তাই খুব ভয় করছিলো।

-অন্তি এ শহরে আরও অনেক রকম সিচুয়েশনে পরতে হবে। এর থেকে বাজেও হতে পারে। তাই নিজেকে প্রটেক্ট করতে শিখো।

-অন্তি ভাব নিয়ে বললো। আমি তো রোজ জিমে যাই।

আরশান অন্তির কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো

-লাইক সিরিয়াসলি অন্তি তুমি জিমে যাও। কেনো?এমন কটকটি শরীরের হাড্ডি গুলো ভাঙ্গার জন্য? আর জিমে গেলেই কি নিজেকে প্রটেক্ট করা শেখা যায়?

-অন্তি মুখ বাকিয়ে জবাব দিলো। আমি মোটেও কটকটি নেই। যথেষ্ট মোটা হয়েছি আগের থেকে। ভালোকরে দেখলিই বুঝতে পারবে।

আর জিমে যাই নিজের শরীরের জড়তাটা কাটানোর জন্য, নাথিং এলস।

আরশান কিছুক্ষন অন্তির দিকে তাকিয়ে থেকে মনেমনে বললো, “তোমার দিকে তাকানোর আর সুজোগ দিচ্ছো কই।”

এরপর দুজন ই চুপ হয়ে গেলো। আর কথা হলো না।

অন্তি জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো

“ওরা যখন একসাথে ঘুরতো অন্তি এতো বকবক করতো আর আরশান শুনতো। ওদের কথা যেনো ফুরোতো না। আরশানতো মাঝে মাঝে মজা করে অন্তিকে টকিং বিল্লি বলেও ডাকতো। আর এখন ওদের কথা বলার টপিক নেই।”

একটা মেয়ের কন্ঠে অন্তি ধ্যান ভাংলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো একটু আগে আরশান যে মেয়েটার সাথে কথা বলেছিলো, ওই মেয়ে এখন যেচে এসে আরশানের সাথে কথা বলতে এসেছে।

মেয়েটা বললো

-আরশান এই মেয়েটার প্রতি তো দেখছি অনেক সিরিয়াস তুমি। কোনদিন তো জোর করে পাশেও বসতে পারি নি। আর আজ তুমি নিজে ওর পাশে বসার জন্য একরকম যুদ্ধ পাকিয়ে ফেললে।

-আরশান টপিক এড়িয়ে বললো,”তোমার রোড চলে এসেছে।”

মেয়েটা মুখ বাকিয়ে বাই বলে চলে গেলো।

অন্তি আবার আরশানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো

-শান ও কে?

-মাই এক্স। (কোনো ভনিতা না করেই আরশান বললো)

-হুয়াট? (আরশানের কথাটায় অন্তি পুরো হা হয়ে ব্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলো)

-এতো রিএক্টের কি আছে? তুমি যাওয়ার পর রিলেশন হয়েছিলো।

-এক্স হলো কেনো?

-আমার ইন্টারেস্ট নেই তাই।

-মানে?

-মানে ও আমার কাছে রোমান্স এক্সপেক্ট করতো। বাট আই কান্ট।

-ওর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস আসে নি।

অন্তি আর কথা বাড়ালো না। আরশান নিজের গন্তব্যের কাছাকাছি এসে অন্তিকে জিঙ্গেস করলো

-অন্তি কোথায় নামবে?

-আরও সামনে। কেনো?

-এমনি।

অন্তিকে একা রেখে আরশান আর বাস থেকে নামলো না। নিজের গন্তব্য ছাড়িয়ে অনেকটা চলে গেলো অন্তির সাথেই। হঠাৎ অন্তি বললো

-তুমি কোথায় নামবে? আমি চলে এসেছি। সাইড দিলে ভালো হয়।

-এখানেই নামবে?

-হ্যা।

-একটা কথা ছিলো।

-বলো।

-এর পর থেকে ব্যাগে ছোট ছুড়ি, কাচি, পিন, নেইল কাটার এগুলো রাখবে। নিজেকে প্রটেক্ট করার জন্য। সবসময় তো আর আমি পাশে থাকবো না।

অন্তি উঠে যেতে যেতে বললো

-আমার আশে পাশে কি আমার চোখের সামনে তুমি আসো এটা আমি চাই না।

-এই শহরটায় আমাদের চলার পথ একই অয়ন্তি হাসনাত। দেখা হতেই পারে। বাট নেক্সট টাইম আই ডেফিনেটলি ইগনোর ইউ। (কথাটা অন্তিকে শুনিয়ে শুনিয়েই আরশান বললো)

অন্তি বাস থেকে নেমে চিৎকার করে বললো

-শুকরিয়া।

পিহু বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অয়ন্তি বারান্দায় বসে আছে। আজ জিমে যেতে হবে না। এজন্য অন্তির আজ মেজাজ টা একদম ফুরফুরা। আরশানকে দেখে অশান্তি হলেও আজ তা প্রকাশ পায় নি। একটু বুক ধুকপুক করেছে, তবে বুকফেটে কান্না আসে নি। কেনো আসে নি তা অন্তির জানা নেই। আরশান ওকে প্রটেক্ট করেছে এটা ওর খুব ভালো লেগেছে। তবে আরশানের এক্সকে দেখে খুব রাগ হয়েছিলো। আরশানের সামনে সবটা নরমালি হ্যান্ডেল করলেও বাসায় এসে যেনো পাহাড় সমান মলিনতা অন্তির মনে ভর করছে। অন্তি চায় না আরশান বার বার ওর সামনে আসুক। এভাবে হুট হাট দেখা হয়ে যাওয়াটা দুজনের জন্যই খারাপ।

অন্তি তার ফুলগাছের একটা বেলি ফুলের গন্ধ নিতে নিতে ফিসফিসিয়ে বললো,”সেদিন যে ও বললো আমাকে ভুলার জন্য এত্তো এত্তো রিলেশন করেছে। তারমানে কথাটা নিছক মাতলামি না। ওর সত্যি এত্তো গুলা এক্স। মানে হয় কোনো? ছি! আমি তো ভেবেছিলাম ওর একমাত্র প্রেম হতে না পারলেও একমাত্র এক্স আমি ছিলাম। এখানেও এক্স এর ঠেলাঠেলি।”

অন্তির মা এসে অন্তির কাধে হাত রাখতেই অন্তি ভয় পেয়ে পিছনে তাকালো। মিসেস হাসনাত হেসে হেসেই বললেন

-অন্তি কি বলো একা একা।

-কই কিছু না আম্মু।

-ওহ। মেডিটেশন ক্লাস থেকে ফোন এসেছিলো। সামনের এক তারিখ থেকেই আসন খালি। কিন্তু তোমার জিম এর টাইমটা চেন্জ করে নিতে হবে।

-আম্মু জিম করাটা কি জরুরি?

-তোমার কি খারাপ লাগে জিমে?

-না। আচ্ছা টাইম চেন্জ করে নাও।

অন্তি বা অন্তির মা আর কথা বাড়ালো না।

আরশানের চোখে শুধু অন্তির চেহারাটা ভাসছে। মেয়েটার সৌন্দর্য যেনো এখন আরও বেশি বেড়ে গেছে। চেহারা থেকে ষোরশী ভাবটা ছেড়ে কেমন যেনো অষ্টাদশী একটা ভাব এসেছে। গোল গোল চশমার ফাকে অন্তির কাজল ভরা চোখ দুইটা আজ আবার ঘায়েল করেছে আরশানকে। আরশানের হঠাৎই মনে হলো অন্তি আরশানের হাত ধরেছে, হাতটা ধীরে ধীরে তার গাল ছুয়ে দিচ্ছে। এরপর কপাল, চুল আর খুব মিষ্ট কন্ঠে বলছে

-এই উঠো আজ কিন্তু আমাকে নিয়ে শপিং এ যাওয়ার কথা ছিলো। আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি। সেই তো বিকাল থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো।

আরশানও দুষ্টামি ভরা কন্ঠে বললো

-শপিং পরে করবো। আগে তো আমার বউটাকে বুকে টেনে নেই।

কথাটা বলেই হাত টান দিয়ে বুকে নিয়ে আরশান চোখ খুলে বুকে পড়ে থাকা অন্তিকে দেখে চিৎকার করে বললে

-সৃজা তুই? সর সরে যা বলছি।

আরশানের চিৎকার শুনেই ওর মা আর নুন দরজায় এসে হাজির।

সৃজা ঝটপট উঠে আরশানের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলো। সৃজা কি আর ইচ্ছা করে আরশানের বুকে গেছিলো, নিজেই তো বউ ডেকে বুকে টেনে নিলো। সৃজা যেন আরশানের আচরনে নিজেও লজ্জা পড়ে গেলো।

অন্তি ব্যাস্ত জীবনে খুব খাপ খাইয়ে নিয়েছে। প্রতিদিনকার রুটিনে অন্তি এখন আর মনমরা হয়ে থাকার সময় পায় না। তবে আজকাল অন্তির কিছু একটা নিয়ে খটকা লাগছে। বিষয়টা যে অন্তি দু একদিন খেয়াল করেছে তা নয়। বেশ কিছুদিন খেয়াল করেছে।

অন্তি সকালে হাটতে বের হলেও লিফ্টে দশতলা থেকে একটা ছেলে উঠে, লিফ্ট থেকে বেরিয়ে বাইরে আসার পর কিছুটা যেয়ে আর ছেলেটাকে দেখতে পায়না। বাসায় ফেরার সময়ও ছেলেটা একই সময় লিফ্টে উঠে দশতলা পর্যন্ত যায়। এইটা যে শুধু সকালেই ঘটে এমন নয়। অন্তির ভার্সিটি যাওয়ার সময়। বাসায় ফেরার সময়। মেডিটেশন ক্লাসে যাওয়ার সময় এমনকি সন্ধ্যায় যখন সব শেষ করে বাড়ি ফেরে সে সময়ও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। এতোটা কোইন্সিডেন্স?

অন্তি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসাথেকে বেড়িয়ে লিফটে উঠলো। আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় দশ মিনিট আগে বের হলো। ছেলেটার রহস্য বোঝার জন্য। কিন্তু আজও লিফট তেরো তলা থেকে দশ তলায় এসে থামার সাথে সাথেই হ্যাংলা পাতলা গরনের ছেলেটা লিফটে উঠে গেলো। অন্তি আজ ভালো করে খেয়াল করছে ছেলেটাকে। বরাবরের মতো আজও চোখ গুলো লাল আর চুলগুলো এলোমেলো। ছেলেটা তাকাতেই অন্তি চোখ সরিয়ে নিলো।

অন্তির আজ যেনো এই রহস্যের উত্তরটা জানতে ইচ্ছে করছে খুব। তাই আজ গেট থেকে বের হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ছেলেটা কি করে, কই যায় তা দেখার জন্য। কয়েক সেকেন্ড পর পিছনে তাকিয়ে যখন কাউকে দেখলো না, অন্তি দৌরে গেটের ভিতরে ঢুকলো। লিফটের কাছে এসেও দেখলো লিফট আপাদত বন্ধ। কেমন যেনো অসস্থি হচ্ছে অন্তির। কোন কিছুর আশঙ্কা করে যেনো হাত পা কাপছে। অন্তি একটু ভেবে চিন্তে ওয়াচম্যানের কাছে গেলো।

লোকটা খুবই বিনয়ী। অন্তিকে কোনোদিন মা ছাড়া ডাকে নি। লোকটাকে দেখলেই কেমন একটা মায়া হয়। পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বয়স হবে হয়তো। এখনো খুব নিষ্ঠার সাথে দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।

অন্তিকে কাছে আসতে দেখেই জহির নামের লোকটা দাড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন,

-কিছু বলবেন মা?

-চাচা একটা উপকার করবেন?

-বলেন মা, কোনে সমস্যা?

-চাচা একটা ছেলে লিফটে আমার সাথে এসেছিলো। উনি কোথায় থাকেন মানে কতো নাম্বার ফ্লোরে থাকেন?আপনি কি জানেন? ওইযে লম্বা করে চুল গুলো এলোমেলো থাকে। আমি আসলে নাম জানিনা

-আপনার সাথে প্রায়ই যে আসে উনি?

-হ্যা।

-ওর নাম তো বিহন।

-বিহন? ওহ। কতো নাম্বার ফ্লোরে থাকে জানেন কি?

-তিন তলায় থাকে মা। মালিকের ছেলে। বাড়িটা ওদের ই। আমি তো ভাবছিলাম আপনার পরিচিতো।

-নাহ চাচা। অন্তি একটু অপ্রস্তুত ভাবে বললো, আচ্ছা আসি চাচা।

নতুন এক আপদ যে অন্তির কপালে জুটেছে এটা মেয়েটা ভালো করেই আচ করতে পারলো।

ছেলেটার চোখের চাহনিতেই কেমন যেনো গা গুলিয়ে আসে অন্তির। সবসময় মনমারা বিষন্ন মুখ আর রাগী লাল চোখ।

বৃহস্পতি শুক্র শনি বার। এই তিন দিন অন্তির ভার্সিটি বন্ধ। তবে আজ বুধবার হলেও অন্তির ক্লাসে যেতে একদমই মন চাইছে না। দুপুরের দিকে আকাশটা কেমন যেনো মেঘ করেছে। যদিও অন্তির আগের মতো বৃষ্টি আর আকর্ষন করে না। বরং পেঁচ পেঁচে লাগে। কোনো কদম ফুল অথবা জারুলের নেশা আর ধরে না। বৃষ্টির পর মাটিতে ঝরে থাকা কাঠগোলাপের গন্ধটাও নেয়া হয় না অনেক দিন। তবে এই সময় এমন ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করার লোভটা যেনো সামলাতে পারলো না অন্তি।

কপালে কু ডাকলে যা হয় আরকি। ছাদের একপাশটায় দাড়ানোর কিছুক্ষনের মাঝেই অন্তি বুঝে গেলো কেউ একজন কাছ ঘেসে দাড়িয়ে আছে। সিগারেটের একটা বিদঘুটে গন্ধও অন্তির নাকে লাগতেই অন্তি ছাদ থেকে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়িয়ে হাটতে ধরলেই কেউ একজন অন্তিকে ডাকদিলো

-অয়ন্তি হাসনাত।

ডাকটা শুনে অন্তির কেমন যেনে বুকটা কেপে উঠলো। পিহুকে কোলের মাঝে আরও শক্ত করে ঝাপটে ধরলো অন্তি। কেমন একটা গমগমে পুরুষালি কন্ঠ।

-অয়ন্তি হাসনাত। চলে যাচ্ছো?

অন্তি পিছন ঘুরে তাকালো। যা আন্দাজ করেছিলো তাই, সেই ছেলেটা। বিহন। কি চায় ও? এখানেও ফলো করছে না তো? অন্তির যেনো হার্ট বিট অনেক দ্রুত চলতে শুরু করেছে।

অন্তি কোনো জবাব না দেওয়ায় বিহন বললো

-বাতাসে তোমার চুলের উড়া উড়ির খেলা দেখছিলাম। উরন্ত ঘুরিও যেনো এতোটা মহোময় হয় না। চলে যাচ্ছো যে?

-জি।

-মেয়ে তুমি জানো খোলাচুলে তোমায় বেশ লাগে। শাড়ি পড়ে তুমি খোপা করেছিলে কেনো সেদিন?

অন্তির মাথায় লোকটার কথাগুলো দুলছে। এ ছেলে হুট করে এসে এতো কথা কেনো বলছে? তবে সিগারেটের গন্ধটা আরও বেশি জঘন্য লাগছে। অন্তি নাক ছিটকালেই বিহন বললো

-সরি তোমার সামনে এটা হাতে দাড়িয়ে আছি। বলেই হাত ঝেড়ে সিগারেটটা ফেলে দিলো।

-আমি আসছি।

অন্তি চলে আসার জন্য আবার ঘুরে দাড়ালে বললো

-তোমার বিড়ালটা খুব সুন্দর। নাদুসনুদুস। অয়ন্তি আজ মেডিটেশন ক্লাসে যাবে? এ মাসটা বরং যেয়ো না। সামনের মাসে আমিও যাবো। আজ থেকেই যেতাম। আর বলো না এক ছেলে এসে জোড় করে একটা মাত্র খালি আসন তা দখল করে বসলো। কেমন লাগে বলো শান্তির জায়গায় মারামারি। সামনের মাসে একটা আসন খালি হবে।

অন্তি আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে খুব দ্রুতই ছাদ থেকে চলে গেলো।

বাসায় যেয়ে ও খুব ভালো করে হিসেব মিলিয়েই বুঝলো এ ছেলে ইচ্ছে করে দশতলা থেকে ওকে ফলো করে। চোখের ভাষাটা আজ অন্তি খুব ভালো করে বুঝে গেছে। এই উদ্ভট বাউন্ডুলের চোখে কি ঘুরছে। এই অসম্ভব প্রেমের ডাককে অন্তি নিজের কানেও পৌছাতে দিতে চায় না।

দুদিন পর অন্তি চোখ খুলে ডান দিক ঘুরে তাকিয়েই চমকে উঠলো। তার পাশেই আরশান চোখ বন্ধ করে গভীর ধ্যানে মগ্ন। চোখ কচলে বুঝতে পারলো এটা নিছকই ভুল ধারনা না। এই ছেলে সত্যি তার পাশে বসা।

ক্লাস শেষ হতে না হতেই অন্তি মুখ বিষিয়ে বললো

-তুমি কি হাত ধুয়ে পড়েছো আমার পিছনে?

-অন্তি তুমি কোনো খাবার নও যে হাত ধুয়ে আসতে হবে।

-তুমি আমাকে রোজ ফলো করো আমি জানি কিন্তু এখানে সামনাসামনি হবে আমি চিন্তা করি নি শান।

-বেশতো। এখন চিন্তা মুক্ত হয়ে দেখো।

অন্তি আরশানের উপস্থিতি রোজ বুঝে। দিনে একবার হলেও যে অন্তির আশে পাশে আরশান আসে এটা অন্তি জানতো। কিন্তু এখানে কি করতে এসেছে কে জানে।

আরশান দরজায় দাড়িয়ে জুতা পড়তে পড়তে বললো

-আর বলো না কোথাকার কোন সাইকো জোড় করে এখানে ভর্তি হবে। আমি একটু বেশি টাকা দিয়েই খালি আসনটা নিয়ে নিলাম।

অন্তি ভাবলেশহীন ভাবে বললো

-বিহনের সাথে ঝগড়া করেছো?

-শুধু কি ঝগড়া আমার কলার চেপে ধরেছিলো আমিও নাকে বসিয়ে দিলাম। সম্ভবত ড্রাগ টাগ নেয়। টাল সামলাতে পারে নি।

আরশানের খেয়াল হলো অন্তির কথাটা

-অন্তি তুমি বিহনকে কিভাবে চিনো?

-আমার বাড়ি ওয়ালার ছেলে।

আরশান কিছুক্ষন অন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো

-অন্তি বাসাটা ছেড়ে দাও। এ ছেলে কাল হয়ে না দাড়ায়।জিমে যাবে?

-হ্যা।

-চলো।

-শান আমি তোমার আগে পিছে চলতে চাইনা।

-আমি পাশে চলতে বলেছি অন্তি আগে পিছে না।

-আমি চাই না।

অন্তিকে আর কিছু বলার সুজোগ না দিয়েই আরশান অন্তির হাত ধরে টেনে এনে গাড়িতে তুললে গাড়ি ছেড়ে দিয়েই আরশান বললো

-অন্তি আমার বাবার অঢেল টাকা পয়সা। এতে আমি একজীবন বসে পার করেদিতে পারবো। কিন্তু এই বিশেষ যোগ্যতায় তোমার হাত ধরে সারাজীবন চলতে চাইলে কেউ মেনে নিবে না। আমাকেও কিছু একটা করতে হবে। মাত্র তো পরালেখা শেষ করলাম। বি এস সি টা কমপ্লিট হলো। এম এস সি করবো। তবে তার আগে একটা চাকরি দরকার।

অন্তি বিরক্তি নিয়েই জবাব করলো

-এসব আমাকে শুনিয়ে লাভ কি?

-তোমার পরিবারে তোমায় চাইতে গেলে আমার নিজের যোগ্যতা লাগবে।

-এখনো আমাকে আশা করার কোনো মানে নেই শান।

-অন্তি আমার আর নুনের সম্পর্ক মারামারি কারা টাইপ এর না। আমরা মারামরি বিহীন বড় হয়েছি ছোট থেকে। ওকে দুইদিন আগে কষে একটা চড় দিয়েছি। এটা যদিও তোমার গালে দেয়া উচিৎ ছিলো।

-হুয়াট?

-হ্যা। তুমি নুন কে সবটা বললে। আবার মানা করলে, আর ও আমাকে বললো না। অন্তি আমাকে সবটা বললে কি হতো?

-শান আমি চাইনি নতুন করে সব শুরু হোক।

-অন্তি এখানে নতুন আর পুরানের হিসাব হচ্ছে কেনো? তুমি আগেও আমার ছিলে এখনো আমার আছো, সারাজীবন আমার ই থাকবে।

অন্তি খেয়াল করলো আরশান রাস্তা পাল্টাচ্ছে। আরশানের দিকে তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বললো

-এ পথে যাচ্ছো কেনে?

-অন্তি আমার কথা শেষ হয়নি তাই। আর যথেষ্ট সময় আছে। কিছুটা পথ ঘুরলে খুব একটা ক্ষতি হবে না।

-আমার হবে। আমি চাইনা তোমার সাথে ঘুরতে।

-অন্তি আমার মনে হয় কি তোমার নিজেরই আগ্রহ নেই আমার প্রতি। তা না হলে বাবা মা চেষ্টা করলেও সব ভুলে থাকা এতো সহজ না।

-বুঝছই যখন বিরক্ত করছো কেনো।

অন্তির এই কথাটাই আরশানের ভেতরটা তুলপার করে দিলো। একটানে গাড়িটা জিমের সামনে এনে দাড় করালো।

আরশানের এই রাগি চাহনিটাই অন্তির কলিজা কাপিয়ে দেয়। অন্তি ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতে নিলে শান আগ বাড়িয়ে দরজা খুলে মুখ কটমট করে বললো

-বিহনের থেকে দূরে থাকবা। ওই ছেলেকে যেনো আশেপাশে না দেখি। আর বাসা চেন্জ করার জন্য বাবা মা কে বলো।

অন্তি নেমে চলে গেলে। আরশান গাড়িটা সাইড করে রেখে বিল্ডিংটার দুই তলায় চলে যায়। নিচ তলায় মেয়েরা আর উপর তলায় ছেলেরা জিম করে।

অন্তি বুঝে গেছে আরশান এখন আবার ওকে আষ্টেপৃষ্টে ধরবে। কিন্তু নুন যদি আরশানকে সবটা না বলে, তাহলে কে বললো আরশানকে?

প্রশ্নটা অন্তির মনে থেকেই গেলো।

অন্তির কপালে বিরক্তির ভাজ। এই ছেলেটা একটা সময় খুব ইগোইস্টিক থাকলেও এখন কিভাবে এতো ছেচরা হলো কে জানে! কেমন নির্লজ্জের মতো এককান ধরে আর এক হাত পকেটে দিয়ে দাড়িয়ে আছে। এই বিশেষ অঙ্গভঙ্গির নাম অন্তির জানা নেই।

মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অন্তি আরশানের চোখে চোখ রেখে কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ এনে বললো

-এমন অদ্ভুত সং সেজে থাকার মানে কি?

-অন্তি আমি মনের গভীর থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। সেদিন অমন করে হুট করে রাগ করে ফেলা উচিত হয়নি। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার উপর জেদ করে পাঁচদিন বাসা থেকেই বের হও নি?

অন্তি কথার জবাব না দিয়েই ক্লাশে ঢুকে গেলো।

আরশান অন্তির উপর প্রচন্ড বিরক্ত থাকলেও প্রকাশ না করে অন্তিকে দেখেই অন্তির পাশে বসে গেলো।

-শান আমি তোমাকে হয়তো বোঝাতে পারছি না। অথবা তুমি বুঝেও অবুঝের মতো হয়ে আছো। আমার পরিবার মানবে না শান। নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কি দরকার?

অন্তি নিরস গলায় কথাটা শেষ না করতে করতেই আরশান বললো

-কারো ফ্যামিলিই মানেনা অন্তি। মানিয়ে নিতে হয়।

-এর আগে কি হয়েছে চারটা বছরেও কি বুঝো নি?নাকি আবার নতুন করে কষ্ট পাওয়ার সাধ জেগেছে?

-তিন বছর সাত মাস তের নাকি চৌদ্দ দিন এটা মনে নেই, ঘন্টা মিনিট হিসাব করি নি।

অন্তি আর কথা বাড়ালো না। এই ছেলেকে হাজার বললেও লাভ হবে না। বিষাদ মুখে চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে গেলো অন্তি।

প্রিয়ার উপর চরম বিরক্ত অন্তি। সেদিন লুকিয়ে অন্তি আর নুনের সবটা কথা শুনে তা আবার আরশানকে বলেও দিয়েছে। একটা বার অন্তিকে জিঙ্গেস করার প্রয়োজনও মনে করলো না। প্রিয়ার সাথে এই জেদে অন্তি কথাই বলে না কয়েকদিন হলো। অন্তি বরাবরই বুদ্ধিমতি। রহস্যটা খুঁজে পেতে ওর বিশেষ কষ্ট হয়নি।

ক্লাশ শেষ করে অন্তি অনুরোধের শুরে বললো

-শান প্লিজ তুমি জেদ নিয়ে পড়ো না।

-কেনো?

-আমি বাবাকে কথা দিয়েছি।

-অন্তি জানোতো ভালোবাসা শর্ত মানে না। আচ্ছা ধরলাম তোমার বাবাকে কথা দিয়েছো। কি কথা দিয়েছো?

-আমি এ সম্পর্কে আর জড়াবো না। এটা নিয়ে আর ভাববো না।

-এটুকুই?

অন্তি চোখ বড় করে তাকালো

-এতটুকুই।

বলেই অন্তি হেটে যেতে লাগলো

আরশান আবার অন্তির পিছনে হেটে হেটে যেতে যেতে বললো

-তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো? ভালোবাসা বাদ দিছো?

-শান, দোহায় লাগে তুমি যাও তো।

-অন্তি সেদিন তোমায় বিয়ের অনুষ্ঠানেই দেখে রাগ উঠে গেছিলো। হুট করে ওইখনে চলে আসবে ভাবি নি। কিন্তু এর পরই হুট করে রাগটা পড়ে গেলো। আবার ভালোবাসাগুলো কেমন যেনো মনের মাঝে নিজ দ্বায়িত্বে উঁকি দিতে লাগলো।

-তো এতো দিন কেনো খোঁজো নি? একটা বারো তো চট্টগ্রাম যাও নি অথবা আমাকে হন্নে হয়ে খুজে যোগাযোগ করো নি। এখন আমাকে দেখেই হঠাৎ পুরোনো প্রেম টা জেগে গেলো? আর এতই আমার জন্য মন কেমন করে তোমার? এই তুমিই তো নিজে সেদিন বললে ডজন খানেক প্রেম করেছো, এক মেয়েকে দেখিয়ে বুকের ছাতি চওড়া করে বললে ও তোমার এক্স। আর এখন আমাকে নিয়ে পড়েছো।

অন্তির কথায় বিশেষ ভ্রুক্ষেপ না করে আরশান অবলীলায় জবাব দিতে যেনো প্রস্তুত। অন্তির প্রতিটি প্রশ্নের সহজ ব্যাখ্যা আরশানের কাছে আছে।

আরশান স্থান কাল না ভেবেই অন্তির গা ঘেসে এসে বললো

-চট্টগ্রাম কি তোমার কাছে এতটুকুনি মনে হয় যে মন চাইলো আর তোমার মতো ঘর কুনোকে টেনে হিচরে বেড় করে আনলাম। অন্তি তুমি চট্টগ্রাম যাওয়ার পর আমাদের নিজেদেরই ঠিক ভাবে কথা হতো না। সেখানে তোমার ঠিকানা তো চাওয়াই হয় নি৷ এটা অবশ্য আমার বড্ড বড় ভুল ছিলো। তুমি কোনো ক্লু রেখে যাওনি। আর শেষ বার তোমার ফোনের কথায় স্পষ্ট করে বলেছো তুমি আমাকে চাও না। এর পর কোন ভরসায় খুঁজতে বের হতাম বলো তো?

অন্তি মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে বলেই ফেললো

-আমি চাইনা এই কথাটা তো এখনো বলছি।

বুঝতে অসুবিধা হলে আবার বলি?শান আমি তোমাকে চাই না।

-বেশ তো মুখে বললে চাও না। কিন্তু তোমার চোখ, তোমার চেহারা, তোমার নারভাস হয়ে যাওয়ায় এক হাতে অন্য হাত চেপে ধরা প্রতিটি অংশ জানান দিচ্ছে তুমি চাও। অনেক চাও আমাকে।

অন্তি দ্রত পা চালাচ্ছে।

আরশান আবার বলতে শুরু করলো

-অন্তি তুমি যদি চাও আমি আমার এক্স গুলারও ব্যাখ্যা দিতে পারি।

অন্তি দাড়িয়ে গেলো। আরশান অন্তির সামনে দাড়িয়ে বলতে লাগলো

-অন্তি তুমি চলে যাওয়ার প্রায় ছ’মাস পর আমার ফ্যামিলি থেকে একটা মেয়েকে আমার সাথে কথা বলতে বলে। আমি ইন্টারেষ্টেড ছিলাম না। মেয়েটা অনেক ট্রাই করেছে। আমি টুকটাক কথা বললেও কখনও গুরুত্ব দেই নি। ও সেচ্ছাই চলে গেছে।

তারপর ওই দিন যে মেয়েটাকে দেখলে ও আমাকে প্রপোজ করলো। আমার মনে হয়েছিলো এখন জীবনটা একটু পাল্টানো দরকার। আমি এক্সেপ্ট করলাম। বেশ কথা হতো আমাদের মাঝে। তবে সব কথা ওই মেয়েই বলে যেতো। কিন্তু না আমি নিজে থেকে কখনও দেখা করতাম না কখনও নিজের ইচ্ছায় কথা বলতাম। ওই মেয়ে চিপকে থাকতো। একটা সময় মেয়েটা আমার কাছে আরও বেশি দাবি করতে লাগলো। ও তখন আমার থেকে বুঝই তো, ফিজিকেল এটাচমেন্ট চাচ্ছিলো। আমি আর মেয়েটাকে কোনো সম্পর্কের সুজোগ দেই নি। আর ওই মেয়েকে এটা বোঝানোর ছিলো যে আমার আর একটা গার্লফ্রেন্ড আছে।

তাই আরিশা নামে একটা মেয়েকে রিকুয়েষ্ট করলাম শুধু আমার জিএফ হয়ে অভিনয় করতে। আরিশা হয়তো আমায় ভালোবাসতো তবে ও আমাকে ওই মেয়ের হাত থেকে রক্ষা করে নতুন করে সম্পর্কের দাবি করে নি।

অন্তি ডজন খানেক নয় এই তিনটা মেয়েই তুমি চলে যাওয়ার পর আমার জীবনে এসেছিলো। না আমি ওদের কাওকে ভালোবেসেছি। না ওদের কাউকে জীবনে জায়গা করে দিয়েছি। আমি শুধু তোমার ভূত মাথা থেকে নামানোর চেষ্টা করেছি অন্তি। আমার পুরোটা জুড়ে তুমি ছিলে সবসময়। কিন্তু সেই তোমার ভূত নামাতে নামাতেই আমার মাথায় এখন ভূতনী হয়ে ঢুকে গেছো অন্তি। তোমাকে দেখার পর থেকে আর আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি অন্তি। আমি তোমাকে পেতে চাই।

অন্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরশানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো

-সৃজা? ও তোমার জীবনের বর্তমান।

-ওর ঘটনাটা আমি তোমায় বলবো না।একদিন তুমি নিজেই জানবে অন্তি। শুধু এটুকু জেনে রাখো আমার ভালেবাসা শুধু তুমি। হাজারটা মেয়ে চাইলেও তোমার জায়গা নিতে পারবে না।

সেদিন জিম শেষে অন্তির সাথে আর কথা বলা হলো না। অন্তির মা অন্তিকে নিয়ে যেতে এসেছিলো।

দিন গুলো খুব যে খারাপ কাটছিলো তা নয় তবে আরশানের এই পাগলামি গুলো যেনো অন্তির মনের সংযম ভেঙে দিচ্ছিলো দিন দিন।

দুজনের কথা বলা তখন সহজ হয়ে এসেছে। এরমাঝেই আরশান একদিন অন্তির হাতে গুজে দিলো একঝাক হলুদ রংএর ফুল। আরশান হাসি মুখেই বললো এটা “রাধাচূড়া” ফুল। দেখোনি বুঝি কোনো দিন?

অন্তির মনে আছে আরশানের সাথে সম্পর্কের পর হাজার অচেনা ফুল দিয়েছে অন্তিকে। একে একে চিনিয়েছে অজানা অনেক ফুলকে। তবে কোনো দিনো গোলাপ এনে দেয় নি। কি অদ্ভুদ একটা ব্যাপার।

এই বিশেষ হলুদ রাঙ্গা ফুল বাসায় এসে ব্যাগ থেকে বের করেই বিচ্ছিরি গন্ধে অন্তির গা গুলিয়ে এলো।একটা ফুল লেপ্টে গেলে এতোটা বাজে গন্ধ হয় অন্তির জানা ছিলো না।

তবে ঘটনাটা আরশানকে খুব হাসিয়েছিলো

আর সেই হাসিটাই অন্তিকে দিয়েছিলো চরম মুগ্ধতা। একুশ বছরের যুবক যখন হঠাৎ করেই চব্বিশ পঁচিশের হয়ে যায়, বিষয়টা কেমন যেনো। চেহারার সেই কিশোর ভাবটা মিলিয়ে এক নিমিষেই সুঠাম দেহী যুবক যেনো অন্তির গাল চেপে বলে” প্রেম কর আমার সাথে।আমাকে ভালোবাস।”

চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতে চায়না অন্তি। বিষয়টা মনের অনেক গভীরে যেয়ে ধাক্কা দেয় কিনা!

আরশানের ভালোবাসার ক্ষমতা একটু একটু করে অন্তিকে দূর্বল করে দিচ্ছিলো। আরশানের বাদামি চোখের চাহনি, ঠোঁটের বাঁকা হাসি, মাতাল করার মতো কথা গুলো অন্তিকে সম্মোহিত করে ফেলছিলো দিন দিন। কখনও তো ইচ্ছা করতো ছুটে যেয়ে বলেই ফেলে যে

-শান আমাদের সম্পর্কের ফলাফল শূণ্য। তবুও চলোনা শূণ্যতা ধরেই হাঁটি।

কিন্তু সেই শূণ্যতাতেও অন্তির ভয়। যে সম্পর্কের ভবিশ্যত নেই সে সম্পর্ককে হাত ধরে এগিয়ে নেয়া অন্যায়। এই একটা চিন্তা যেনো অন্তিকে থামিয়ে রাখে সবটা থেকে।

ভার্সিটিতে যেতে আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। লিফটে উঠে বরাবরের মতোই বিহনকে দেখে অন্তি একপাশটায় চিপকে দাড়ালে বিহন অন্তির সামনে এসে বললো

-অয়ন্তি হাসনাত। আজকাল তুমি অনেক ব্যাস্ত তাইনা?সব জায়গায় একপ্রকার ছুটেই যাও।

-অন্তি মুখে হাসি রেখে চশমা ঠিক করতে করতে বললো, তেমন কিছু না ভাইয়া।

-যখনই দেখি তখনি কেমন যেনো তাড়া দেখাও খুব।

অন্তি আর কোনো কথা না বললেও বিহন লিফট তিনতলার কাছে আসতেই অন্তির হাত চেপে ধরে বললো

-অয়ন্তি আমি কিছু বলতে চাই। অয়ন্তি তুমি কেনো আমাকে দেখলে চুপসে যাও?

বিহনের মুখে যতোটা আকুতিই থাকুক না কেনো অন্তি যেনো ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। এই ছেলে এভাবে হাত চেপে ধরবে অন্তি চিন্তাও করে নি।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসেই অন্তি হাত ছুটিয়ে এক দৌরে গেট ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো। এখন ঘরে ফিরে গেলেও যে বিহন তার পথ আটকাবে না তার কি নিশ্চয়তা। রিক্সায় উঠেই ব্যাগের ভিতরের কাচি, সেফ্টিপিন, দেখে নিলো।এর থেকে বাড়াবাড়ি করলে হয়তো এগুলোই কাজে লাগতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *