বাপের বাড়ি
অফিসে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে মা আমায় ডেকে বললো,
-“তোর বউয়ের তো ৭মাস চলছে। তা বউমাকে কবে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবি?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে মাকে বললাম,
–ঠিক বুঝলাম না মা! এই অবস্থায় শ্রাবণীকে(আমার বউ) বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো কেন?
মা তখন বললো,
-“দেখ আমাদের বংশের একটা নিয়ম হলো বাড়ির বউয়ের প্রথম সন্তান বাপের বাড়ি হয়। প্রথমবার বাচ্চার মা হবে বলা তো যায় না কখন কি হয়। কিছু একটা হলে দেখা যাবে তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের দায়ী করবে”
আমি মাকে বললাম,
— মা, তুমি তো জানোই আমার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে তাছাড়া ওদের বাসা থেকে হাসপাতাল ক্লিনিক অনেক দূরে। আল্লাহ না করুক, দেখা গেলো শ্রাবণীর কোন সমস্যা হলে ওরা সময় মত হাসপাতালেই নিয়ে যেতে পারবে না। তারচেয়ে শ্রাবণী এইখানেই থাকুক।তাছাড়া শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকলে একটা কথা ছিলো। এই অবস্থায় ও বাপের বাড়ি গেলে ওর দিকে কে খেয়াল রাখবে?
আমার কথা শুনে মা বিরক্ত হয়ে বললো,
-” জানিস বাচ্চা হলে কত টাকা খরচ হয়? আজকাল মেয়েরা তো নবাবজাদী হয়ে গেছে।একটু ব্যথা সহ্য করতে পারে না। তাই ব্যাথা উঠার আগেই পেট কেটে বাচ্চা বের করে ফেলে। তাছাড়া এইসব সিজার করতে অনেক টাকা পয়সা লাগে। তাই আমার কথা মত বউমাকে ওর বাপের বাড়ি দিয়ে আয়।ওদের মেয়ে ওরা এইসব ঝামেলা দেখুক
আমি মুচকি হেসে মাকে বললাম,
— শ্রাবণী ওদের বাড়ির মেয়ে হলেও সে এখন আমার স্ত্রী আমার অনাগত সন্তানের মা। তাই ওদের থেকে আমার দায়িত্ব আর কর্তব্যটা অনেক বেশি। মা, আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি গেলাম।আর কয়েকটা টাকা পয়সার জন্য আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবো না
এই কথা বলে আমি যখন মা’র রুম থেকে বের হলাম তখন খেয়াল করি শ্রাবণী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে শ্রাবণী শুকনো হাসি হেসে বললো,
-“পিয়াস, আল্লাহ রহমতে আমার কিছু হবে না। তুমি আমায় আমার বাপের বাড়ি দিয়ে এসো”
শ্রাবণীর শুকনো হাসির পিছনে কতটা কষ্ট আর অভিমান জমা ছিলো সেটা আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম।
আমি তখন ওর হাতটা ধরে বললাম,
— তোমার মুখে শুকনো হাসি মানায় না, সতেজ হাসিটা বেশি মানায়।চিন্তা করো না আমি আছি তো তোমার পাশে ….
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বিকাল ৫টা বেজে গেলো। আমি তড়িঘড়ি করে বাসায় ঢুকে শ্রাবণীকে বললাম,
–তুমি তৈরি হয়ে নাও তো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
শ্রাবণী তখন বললো,
-” আমি ঠিক আছি তো। শুধু শুধু ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না”
শ্রাবণীর কথা শুনে আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম,
— তোমার এত বুঝতে হবে না। ডাক্তার বলেছিলো ১৫ দিন পর পর একবার চেকাপ করাতে আর আজ ১৭ দিন চলছে। যাও তৈরি হয়ে আসো
শ্রাবণীকে নিয়ে বাসা থেকে বের হবার সময় মা আমাদের দেখে বললো,
-” তোদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। আমিও দুই সন্তানের মা হয়েছি। আমার কখনো দুইদিন পর পর ডাক্তারের কাছে তোদের মত দৌড়াতে হয় নি
মা’র কথা শুনে আমি হেসে বললাম,
— মা, দরজাটা লাগিয়ে দাও। আমাদের আসতে ১ঘন্টার মত দেরি হবে…
ডাক্তারের চেম্বারের সামনে যখন বসে ছিলাম তখন খেয়াল করি শ্রাবণী মাথা নিচু করে নিরবে চোখের জল ফেলছে। আমি তখন ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,
– প্লিজ মা’র কথায় কিছু মনে করো না। সেকালের মানুষ তাই এত কিছু বুঝে না। আমি আছি তো তোমার পাশে…
অফিসের বস এপ্লিকেশনটা হাতে নিয়ে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” বাচ্চা হবে আপনার স্ত্রীর আর আপনি ছুটি চাইছেন একমাসের।ব্যাপারটা কি?
আমি বসকে বললাম,
— স্যার, আমি এখন থেকে পুরোটা সময় আমার স্ত্রীর পাশে থাকতে চাই
বস কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
-” তাই বলে এক মাসের ছুটি আমি আপনাকে কিভাবে দিবো?” আপনি মহিলা হলে আপনাকে না হয় গর্ভকালীন ছুটি দেওয়া যেতো কিন্তু আপনি তো পুরুষ। আপনাকে কিভাবে এত দিনের ছুটি দেই?
আমি বসকে তখন বললাম,
— গর্ভকালীন ছুটিটা একজন গর্ভবতী মহিলার পাশাপাশি একজন পুরুষেরও সেটার প্রাপ্য। প্রতিটা পুরুষের দায়িত্ব স্ত্রীর গর্ভকালীন এইসময়ে স্ত্রীর পাশে থাকা। তেমনি প্রতিটা স্ত্রীও চায় এই সময়টাতে তার স্বামী যেন তার পাশে থাকে। ৬ বছর চাকরি করে এই কোম্পানিকে আমি অনেক কিছু দিয়েছি।কোম্পানি কি আমায় এখন ১মাস সময় দিতে পারে না?আমি তো বেশি কিছু চাই নি
বস আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনে বললো,
– ঠিক আছে, আপনি যান আমি বিষয়টা দেখছি..
কয়েকদিন হলো বড় আপা আমাদের বাসায় এসেছে। আমি অদ্ভুতভাবে খেয়াল করছি বড় আপার যে কাজ গুলো নিজের করা উচিত সেই কাজ গুলো শ্রাবণীকে দিয়ে করাচ্ছে।সেদিন খেয়াল করি বড় আপা একমনে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে আর শ্রাবণীকে বলছে,
~”আমার বাচ্চার দুধটা একটু গরম করে দাও তো”
আরেকদিন শুনি বড় আপা বিছানায় শুয়ে থেকে শ্রাবণীকে ডেকে বললো,
~”আমার মাথাটা খুব ব্যাথা করছে। আমায় এককাপ কড়া করে কফি বানিয়ে দাও তো”
আজ সকাল থেকেই শ্রাবণীরর শরীরটা একটু খারাপ। এই অবস্থায় বড় আপা শ্রাবণীকে বললো,
~” তোমার হাতের পাটিসাপটা পিঠা তোমার দুলাভাই খেতে খুব পছন্দ করে৷ তুমি আজ আমায় কতগুলো পাটিসাপটা পিঠা বানিয়ে দিও তো”
আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম আমার বড় বোনের কথা শুনে।তাই কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম,
— তোর জামাইকে তুই নিজে পিঠা বানিয়ে খাওয়া তুই আমার বউকে বলছিস কেন?
বড় আপা তখন মুখ বাঁকিয়ে বললো,
~” বউয়ের চামচামি করছিস নাকি?”
আমি বললাম,
— আমি কোন চামচামি করছি না। শুধু তোর মত একটা শিক্ষিত মেয়ের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছি।তুই নিজেও একবাচ্চার মা। তুই তো বুঝিস এই সময় একটা মেয়ের কত রকম সমস্যা হয়৷ তুই কি করে এই অবস্থায় আমার বউকে বলিস তোর বাচ্চার দুধ গরম করে দিতে, তোর জন্য কফি বানিয়ে দিতে, আর আজ বলছিস তোর জামাইয়ের জন্য পিঠা বানাতে? মেয়েটা প্রথমবার মা হচ্ছে। মনে কত রকমের ভয় থাকতে পারে। কোথায় তুই শ্রাবণীকে একটু সাহায্য করবি, একটু মনে সাহস দিবি যেন সে ভয় না পায়। তা না করে উল্টো তুই ওকে পিঠা বানাতে বলছিস
এমন সময় মা খুব রেগে গিয়ে বললো,
-” আমি এমন ছেলে পেটে ধরেছি যে কিনা নিজের বউয়ের জন্য নিজের বড় বোনকে কথা শোনাচ্ছে। কি এমন তোর বউকে বলেছে যে তুই তোর বোনকে কথা শোনাচ্ছিস? কয়েকটা পিঠা বানিয়ে দিতেই তো বলেছে। অথচ তোরা যখন পেটে ছিলি তখন আমি সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করতাম”
আমি মা’র দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
— মা আমার বোন যখন প্রেগন্যান্ট ছিলো তখন তুমি ৫ মাস যেতে না যেতেই আপা কে শ্বাশুরবাড়ি থেকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলে যাতে আপার ওখানে সংসারের কোন কাজ করতে না হয়। আমি দেখেছি আপাকে দিয়ে তুমি কাজ করাবে দূরে থাক আপাকে কখনো রান্নাঘরে যেতে দাও নি। সেই তুমিই ছেলের বউয়ের বেলায় এতটা বদলে গেলে…
আমি যখন মা আর আপাকে কথা গুলো বলছিলাম তখন শ্রাবণী আমাকে বারবার থামতে বলছিলো তখন আপা শ্রাবণীকে বললো,
~” থাক থাক নিজেকে স্বামীকে মা বোনের উপর খেপিয়ে দিয়ে এখন আমাদের চোখে ভালো সাজতে হবে না”
কথাটা শুনে শ্রাবণী মাথা নিচু করে অন্য রুমে চলে গেলো। আমি তখন আপার দিকে তাকিয়ে বললাম,
–মূর্খ মানুষ অবুঝ হলে তাকে বুঝানো সহজ। কিন্তু কোন শিক্ষিত মানুষ অবুঝ হলে তাকে বুঝানো সত্যি খুব কঠিন
—
—-
রুমে ঢুকে দেখি শ্রাবণী জানালার গ্রীল ধরে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
— চিন্তা করো না আমি আছি তো তোমার পাশে…
শ্রাবণী আমার দিকে ফিরে শুকনো হাসি দিলো আর আমি তখন বললাম,
— তোমার মুখে শুকনো হাসি মানায় না, সতেজ হাসিটা বেশি মানায়।
—- (সমাপ্ত) —-