সারাদিন বাসায় ফেরোনি। তুমি এখন যথেষ্ট বোঝ। এভাবে সারাদিন বাসার বাহিরে থাকা কি সোভা পায়?’
প্রিয়তা মাথা নিচু করে রইল। উত্তর দিলো না। জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরপর বলল,
‘তাহলে তোমার মামি আমাকে যা কিছু বলেছে সব সত্যি? তুমি সত্যিই কারো কথা শুনছ না?’
প্রিয়তা এবারো কোনো কথা বলল না। তার ভিষণ অভিমান হলো। সে তো মাত্র আজ একদিন বাহিরে ছিল। মামা কিভাবে মামির সবকথা বিশ্বাস করে নিল?
প্রিয়তার নিস্তব্দতা জাহিদের পছন্দ হলো না। তার মনে হলো অতি আদর দিয়ে প্রিয়তাকে সে চরম বিয়াদপ বানিয়ে ফেলেছে। বাড়ির মেয়ে কাউকে না জানিয়ে সারাদিন ঘরের বাহিরে থাকছে এটা মানুষ জানলে কত কথা রটাবে! তিনি আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তোমার বয়সের মেয়েরা সংসার করে খাচ্ছে। তোমার আপত্তি থাকায় এতদিন আমি তোমায় কিছু বলিনি। কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। আমি চাই খুব শীঘ্রই ভালো কোনো পাত্র দেখে তোমায় তার হাতে তুলে দিতে। আশি করি তোমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘যদি থাকে?’
প্রিয়তার পশ্নে জাহিদ ভিষণ রকম বিরক্ত বোধ করলো। কপাল কুঁচকে তিনি কঠিন কন্ঠে বলল,
‘এখনো তুমি বলতে চাইছ তোমার আপত্তি আছে? আমার ঘরেও একটা মেয়ে আছে। আমার একটা সংসার আছে এটা ভুলে যেও না। আমি চাইনা তোমাকে নিয়ে এ সংসারে আর কোনো ঝামেলা হোক। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।’
কথাগুলো বলে জাহিদ গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। প্রিয়তা ঠাঁয় বসে রইল। জাহিদের বলা কথাগুলো বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ মামাও তাকে বলতে চাইল সে এই পরিবারের অশান্তির কারণ! প্রিয়তা উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। তার নিজেকে ভিষণ একা লাগছে। এলোমেলো অবস্থায় বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল। তাকে একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আর কত অবহেলা সইবে সে? এ বাড়ির কেউ তাকে মানুষ ভাবে না। তার যে একটা মন আছে সেটাই সবাই ভুলে বসেছে। প্রিয়তার জীবনে বন্ধুর সংখ্যা খুব সীমিত। এত বছর জীবনে হাতে গোনা কয়েকটা বন্ধু হয়েছে তার। অনেক খুঁজে নীরার নাম্বার বের করলো সে। ভার্সিটির জীবনে নীরাই ছিল তার সবথেকে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু অনার্স শেষ করার পূর্বেই তার বিয়ে হয়ে যায়। পড়িশোনা টাও শেষ করা হলো না মেয়েটার। বিয়ে হতেই পরিবর্তন আসলো নীরার। সব মেয়েরাই বুঝি পরিবর্তন হয়?
এতদিন বাদে কল দিতে একটু সংকোচ অনুভব হলেও প্রয়োজন এর খাতিরে বাধ্য হয়ে কল করতে হলো। তার উপর রাত এখন দশটার বেশি। এত রাতে কাউকে কল দিয়ে বিরক্ত করা মোটেই শোভনীয় কাজ নয়। প্রিয়তার ভিষণ অপছন্দের তালিকায় থাকা অন্যতম কাজ এটি। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।
‘কে বলছেন?’
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলল,
‘জ্বি এটা নীরার নম্বর?’
‘হ্যাঁ। কি চাই?’
‘নীরাকে।’
‘ওর কাছে কি চাই?’
প্রিয়তা বিরক্ত হলো এমন প্রশ্নে। ওর কাছে কি চাই সেটা না হয় ওকেই বলবো। তোর তাতে কি ভাই? কিন্তু প্রিয়তা এমন কিছু বললো না। সে ভিষণ বিনয়ের সুরে বলল,
‘ওকে একটু দরকার ছিল। আমি ওর ফ্রেন্ড প্রিয়তা। একটু যদি ওর কাছে ফোনটা দিতেন ভিষণ উপকৃত হতাম।’
লোকটার প্রতিক্রিয়া ঊ্এপাশ থেকে প্রিয়তা বুঝলো না। কিন্তু যতটুকু অনুমান করলো লোকটা ভিষণ রকম বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে আছে।
‘হুম অপেক্ষা করুণ। ও বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে।’
‘জ্বি অবশ্যই।’
প্রিয়তা ফোন কানে অপেক্ষা করলো। পাক্কা তিন মিনিটের মাথায় নীরার কন্ঠ ভেসে এলো।
‘হ্যালো! প্রিয়তা বলছিস?’
প্রিয়তা ভিষণ বিরক্ত বোধ করলেও হাসগ মুখে বলল,
‘হ্যাঁ। কেমন আছিস? কতদিন বাদে তোর সাথে কথা বলার সুযোগ হলো।’
প্রিয়তার কথা বলার ধরণ এমন যেন সে নীরার সাথে কথা বলতে পেরে ভিষণ আনন্দিত। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে সে প্রচন্ড রকম বিরক্ত। নীরার হাসবেন্ড শুরুতেই তার মেজাজের দফারফা করে ফেলেছে। টুকটাক কথা শেষে প্রিয়তা মলিন কন্ঠে বলল,
‘একটা হেল্প করতে পারবি?’
‘হুম বল।’
‘একচুয়ালি আমার একটা বাসা দরকার। ছোট একটা ফ্লাট। আমার একার থাকার মতো।’
‘আচ্ছা আমি তোকে জানাব।’
‘ধন্যবাদ।’
প্রিয়তা ফোন রাখল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ফোনের দিকে তাকাতে দেখলো আয়াজ ম্যাসেজ করেছে। প্রিয়তার রিপ্লাই দিতে মন চাইলো না। তার এখন ভিষণ ঘুম পাচ্ছে। ভিষণ বলতে ভিষণ। প্রিয়তা ফোন সাইলেন্ট করে টেবিলে রাখল। সে জানে কিছুক্ষণ বাদে আয়াজ কল করবে। একবার নয় দুবার করে টানা একঘন্টা কল করবে। অতঃপর প্রিয়তা ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সুন্দর করে একটা ম্যাসেজ পাঠাবে। এই ছেলেটার জাবতীয় কাজ এখন প্রিয়তার মুখস্থ হয়ে গেছে।
প্রিয়তা একটা বাসা খুঁজে পেয়েছে। এক বেডের ছোট্ট একটা ফ্লাট। ছয় হাজার টাকায় এর থেকে ভালো বাসা পাওয়া অসম্ভব। নীরার মামা শ্বশুরের বাড়ি হওয়ায় অল্প ভাড়ায় সহজে বাসাটা পেয়ে গেছে সে।
সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ হতে প্রিয়তা কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,
‘আমি এ মাসেই শিফট করছি।’
জাহিদ অবাক চোখে তাকালো। বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,
‘শিফট করছো মানে?’
‘এটস সিম্পল। আপনাদের সংসারে আর কতদিন? তাছাড়া আমার জন্য আপনাদের কম ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছেনা। এখন যেহেতু আমি নিজেই চলতে পারি। নিজেকে চালাতে পারি তাই আমি আমার মতো করে থাকতে চাই। বলতে পারেন নিজের বাকি জীবনটা নিজের মতো করে চালাতে চাই। আপনাদের ও ছুটি দায়িত্ব থেকে।’
কত বড় একটা কথা কত সহজেই বলে ফেলল প্রিয়তা। প্রিয়তার গলা ধরে আসতে চাইছে কিন্তু সে শক্ত হয়ে বসে রইল। জাহিদ নির্বাক হয়ে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকালো। সে কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি প্রিয়তা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিবে। সে তো সবসময় প্রিয়তাকে নিজের মেয়ের মতো করেই দেখেছে। তার চোখের কোণে পানি জমলো। মুচকি হেসে সে বলল,
‘তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ এখানে আমার আর কি বলার! তুমি বড় হয়েছ। নিজের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পার। তোমার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।’
তিনি উঠে চলে গেলেন। সুজলা কোনো কথা না বলে স্বামীর পিছু পিছু রুমে চলে গেল। তুলি অনেক আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছে। প্রিয়তা টেবিলে বসে রইল। সবাই চলে যেতেই রত্না দৌড়ে এলো।
‘আপা আপনে সত্যিই চইলা যাবেন?’
প্রীয়তি মাথা নাড়াল। রত্না মন খারাপ করলো একটু। পরক্ষণে বলল,
‘এতদিনে আপনি একটা সঠিক কাজ করছেন আপা। একটু খারাপ লাগলেও আমি খুশি হইছি। আপনি চিন্তা করবেন না। দুইদিন পরপর আমি আপনারে দেখতে যামুনি।’
প্রিয়তা হেসে ফেলল। কিছু ভালোবাসা হয় নিঃস্বার্থ। এই যে রত্নার তার প্রতি ভালোবাসা। কতটা নিঃস্বার্থ ভাবে মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা আপন মানুষদের কাছ থেকেও পাওয়া যায় না।
দুদিনের মাথায় প্রিয়তা নতুন বাসায় উঠলো। রত্না পুরোটা দিন প্রিয়তার হাতে হাতে ঘর গুছিয়ে দিলো। প্রিয়তা ওর মামার বাড়ি থেকে কিছুই আনেনি। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস সব নিজেই কিনে নিয়েছে। যদিও জাহিদ অনেক জোরাজুরি করেছিল কিন্তু প্রিয়তা সাফ মানা করে দিয়েছে। সুজলা প্রিয়তাকে কঠিন ভাবে বলে দিয়েছে সে যেন আর এ বাড়িতে ফিরে না আসে। উত্তরে প্রিয়তা মুচকি হেসে বলেছিল,
‘চিন্তা নেই মামি। আপনাদের মুক্তি দেওয়ার শপথ যখন করেছি সেটা পরিপূর্ণ ভাবেই সম্পন্ন করবো।’
তুলি ভিষণ কেঁদেছিলো। বারবার প্রিয়তাকে না যেতে বলছিল। প্রিয়তা ওকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে ছিল। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও ঝড়েনি। কষ্ট পেতে পেতে তার হৃদয় পাথর হয়ে গেছে।
বিকেল হওয়ার পূর্বেই রত্না চলে যায়। প্রিয়তা সব গুছিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। সূর্য হেলে পড়েছে। লাল রাঙা আকাশে কয়েকটা কাক উড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রিয়তা বিষন্ন মনে আকাশের দিকে তাকালো। চোখের কোণে জলরাশির দেখা মিলল। ধরে আসা গলায় বলল,’সব খারাপ কেন আমার সাথেই হয়? আমাকেই কেন সব হারাতে হয়?’
‘কেন ইগনোর করছেন প্রিয়তা?’
আয়াজের কন্ঠের গভীরতা অনেক। সাধারণত আয়াজ তাকে প্রিয়তা বলে ডাকে না। এটা তখনই ডাকে যখন আয়াজ খুব রেগে থাকে কিংবা যখন খুব বেশি কষ্ট পায়। প্রিয়তা তপ্ত শ্বাস ফেলল। শান্ত ভাবে বলল,
‘তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত আয়াজ। আমিতো পালিয়ে যাচ্ছি না।’
‘যেতে চাইলেও যেতে দিব না।’
‘দিও না। তবুও পড়াশোনায় ফোকাস কর।’
আয়াজ হাসলো। প্রিয়তার নাক টেনে দিয়ে বলল,
‘আপনি প্রোফেশনাল টিচারের মতো ব্যাবহার করছেন প্রিয়।’
প্রিয়তা চমকালো। আজকাল সে একটুতেই চমকে যায়। এই ছেলেটার তাকে চমকে দেওয়ার বিশেষ রকম ক্ষমতা রয়েছে। প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। কন্ঠে তেজ এনে বলল,
‘তুমি এভাবে যখন তখন আমায় ছুঁবে না আয়াজ।’
আয়াজ ব্যাথিত হলো। হাত গুটিয়ে নিয়ে ছোট করে জবাব দিলো,’স্যরি।’
ইতিমধ্যে পার্কে অনেক কপোত কাপতির ভীড় জমেছে। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ঝিমিয়ে থাকা পার্কটি। প্রিয়তা আড় চোখে আয়াজের দিকে তাকায়। কালো রঙের শার্ট উজ্জল শ্যামলা দেহে দারুণ মানিয়েছে। হঠাৎ করেই প্রিয়তার মন খারাপ হলো। সে উদাস হয়ে বলল,
‘পিচ্চি! কেন তুমি আমার বড় হলে না?’
প্রিয়তার কথায় আয়াজ গম্ভীর হলো। প্রিয়তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকালো। কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘আমাকে আর কখনোই পিচ্চি সম্মোধন করবেন না। এর শাস্তি দিতে আমি কৃপণতা করবো না।’
প্রিয়তার মনে হলো সে এই পিচ্চি ছেলেটাকে ভয় পাচ্ছে। তার ভয় পাওয়া উচিত না কিন্তু সে পাচ্ছে। এই শীতল গলার স্বর তাকে জমিয়ে দিচ্ছে। সে চেয়েও পারছে না আয়াজের কথার অমান্য করে তাকে পিচ্চি বলে ডাকতে। কিন্তু সে বলতে চাইছে,’পিচ্চি! আমাকে ধমকানোর আগে পাঁচ বার ভাববে। কেননা আমি তোমার থেকে গুনে গুনে পাঁচ বছরের বড়।’একের পর এক ম্যাসেজ আসছে। প্রিয়তা কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই নিখিলের সমস্যা কি? এত ম্যাসেজ কেন দিতে হবে? আর সে ম্যাসেজ দিলেও বা প্রিয়তা কেন রিপ্লাই করবে? প্রিয়তা আবারো বইয়ে মন দিল। অবহেলায় পড়ে রইলো ফোনটি আগের স্থানে। এর মাঝে ডোরবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখল বাড়িওয়ালা দাদু থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা বুঝে না সবসময় এমন থমথমে মুখ করে থাকার কারণ। দিদাকি তাকে আদর যত্ন করে না? প্রিয়তা মিষ্টি হেসে সালাম দিল। জবাবেও দাদু থমথমে মুখে তাকালো।
‘কিছু বলবেন দাদু?’
‘আমার বাড়িতে থাকতে কিছু নিয়ম আছে। সেগুলোই জানাতে এসেছি।’
এমন কাঠকাঠ কথায় প্রিয়তা না চাইতেও বিভ্রান্ত হলো। মানুষ বুঝি শুরুতেই এমন কথা বলে!
‘জ্বি। ভেতরে এসে বসুন?’
লোকটা জবাব দিলো না। তবে হাতের ইশারায় বুঝাল সে এখানেই ঠিক আছে। প্রিয়তা নড়েচড়ে দাঁড়াল। তার কেমন জানি নিজেকে আসামি আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধকে জজ বলে মনে হচ্ছে। প্রিয়তার একটা ভুল কথা তার প্রাণ কেড়ে নিবে এমন দমবদ্ধ অনুভূতিতে প্রিয়তা হাঁসফাঁস করে উঠলো। বাড়িওয়ালারা বুঝি এমনই হয়!
‘চাকরি কর নাকি?’
‘জ্বি।’
‘রাত করে বাড়িতে ফেরা চলবে না। সে তুমি যত বড় চাকরিই কর না কেন।’
প্রিয়তা ঝটপট জবাব দিলো,
‘জ্বি না বড় চাকরি করি না। প্রাইমারি স্কুলের গেস্ট টিচার।’
লোকটা চশমার উপর থেকে কপাল কুঁচকে তাকালো। এখানে কপাল কুঁচকানোর কি আছে? প্রিয়তার ইচ্ছা হলো লোকটাকে বলতে,’দাদু আপনার কপালের চামড়া কি ছোট থেকেই অমন কুঁচকানো?’
‘দরজা জানালা আটকাই থাকবে। একা মেয়ে মানুষ। সাবধানতা নিজের মধ্যে। আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম মাত্র। আমি এখন যাচ্ছি তুমি দরজায় খিল দাও।’
‘জ্বি দাদু।’
কিছুদিন ধরে আয়াজ ভিষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। প্রিয়তার সাথে তার দেখা হয়না এক সপ্তাহের বেশি। কেবল রোজ রাতে সময় করে দশ মিনিট ভিডিও কলে কথা হয়। দুজন মানব মানবী নিরবে একে অপরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। দুজনেই সারাদিন বাদে তার প্রিয় মানুষটাকে দুচোখ ভরে দেখে নেয়। তাদের সকল ক্লান্তি একে অপরের চোখে তাকিয়েই যেন দূর হয়ে যায়। তবে এ নিয়ে দুটো মানুষের কারোর কোনো অভিযোগ ছিল না। সুন্দর করে মানিয়ে নিয়েছে তারা। তবে আজ ঘটনা ভিন্ন। রাত একটা বাজতে চলছে কিন্তু আয়াজের কোনো খোঁজ নেই। কল করলেও রিসিভ হচ্ছে না। চিন্তিত হয়ে সারা ঘর জুড়ে পায়চারি করছে প্রিয়তা। একটুতে উত্তেজিত হওয়া মানুষ নয় সে। তবুও সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেতে শুরু করেছে। মাথার মাঝে এলোমেলো অগুছালো খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু হলো না তো ছেলেটার!
ঘড়িতে রাত একটা বেজে সাতাশ মিনিট। ঘড়ির কাঁটার টিক টক শব্দ আর মশার গুনগুন গান পরিবেশকে থমথমে করে তুলেছে। প্রিয়তার রুমের লাইটটি এখনো জ্বলছে। ঘুমঘুম চোখে প্রিয়তা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বুঝে আসতে চাইছে যেন। কিন্তু তার অবচেতন মন বলছে এখনি কল আসবে। তার মনের কথা বৃথা যায়নি। নিঃশব্দ কামরার দ্যজা জানালা কাঁপিয়ে বেজে উঠলো ফোন। প্রিয়তার ঠোঁট কোনে খেলে গেল এক টুকরো হাসি। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সময় নিয়ে আয়াজ উত্তর দিলো,
‘ক্ষুদা পেয়েছে প্রিয়তা। একটু নিচে আসবে? ভাত আছে?’
প্রিয়তার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। চোখ ভরা ঘুম যেন নিমিষেই উদাও হয়ে গেলো। শিরশির করে কেঁপে উঠলো দুচোখের পাতা। প্রিয়তা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
‘আমি আসছি।’
কল কেটে যাওয়ার পরও দু মিনিট থম মেরে বসে রইল সে। আয়াজ ছেলেটা দিন দিন বড্ড পাজি হয়ে যাচ্ছে! কেমন করে ডাকে! “প্রিয়তা!” আবার তুমি করেও বলছে! প্রিয়তা বড় করে শ্বাস নিলো। ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘরে যেয়ে প্লেটে ভাত তুলে নিল। ডাল ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্যস্ত হাতে একটা ডিম ভেজে নিল। ব্যাস এতেই চলবে।
ল্যাম্প পোস্টের আলোতে ফরমাল পোশাক পরিহিত আয়াজকে প্রিয়তার একজন অতিবসুদর্শন পুরুষ বলে মনে হলো। আয়াজের ক্লান্তিতো মোড়ানো মুখটা তার সৌন্দর্যের কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। প্রিয়তা এগিয়ে আসতেই আয়াজ গাড়ির ডোর খুলে দিল। প্রিয়তা কোনো প্রশ্ন করলো না। চুপচাপ উঠে বসলো। আয়াজ গাড়ির ভেতর ঢুকে ডোর লক করে দিল।
‘এত রাতে আমার বাসার সামনে কেন?’
‘তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রেমিকা নেই আমার তাই।’
আয়াজের উত্তরে প্রিয়তার বুকের ভেতর আবারো ছলকে উঠলো। ছেলেটার কথা এমন কেন? তার প্রত্যেকটা কথা প্রিয়তার বুকের ভেতর কাঁচের মতো গেঁথে যায় তা কি সে জানে না? নাকি জেনে বুঝেই প্রিয়তাকে ঘায়েল করতে এই অস্রের ব্যাবহার!
‘বাড়িতে তোমার মা রান্না করেনি?’
আয়াজ গম্ভীর উত্তর দিলো,
‘আমার মা তোমারও মা হয় প্রিয়তা। এরপর আর কখনো এভাবে বলবে না। মা বলে সম্বোধন করবে। আমার সবকিছু তোমার। ইভেন মা টাও।’
প্রিয়তা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল।
‘খাইয়ে দাও।’
প্রিয়তা পিটপিট করে তাকালো। এই পুচকে তার উপর হুকুম জারি করছে!
‘হাত নেই তোমার? খেয়ে নাও। আর কখনো এমন পাগলামি করবে না। যদি কেউ দেখে নেয় কি হবে বুঝতে পারছ?’
‘বিয়ে করে নিব। প্রবলেম সলভ।’
প্রিয়তা রেগে গেল। সিরিয়ায় ব্যাপারেও ছেলেটার গা ছাড়া ভাব। তার এ ধরণের ব্যাবহার একদম পছন্দ না। প্রিয়তা কিছুটা কঠিন হয়ে বলল,
‘তোমার বাচ্চামি বন্ধ কর আয়াজ। বিয়ে বললেই বিয়ে হয়ে যায় না। তুমি এখনো বাচ্চা রয়ে গেছ। তোমার পরিবার কখনো আমায় মেনে নিবে? আমার যোগ্য সম্মান তোমার পরিবারের কাছ থেকে দিতে পারবে তুমি?’
প্রিয়তা রাগে ফুঁসে চলছে এখনো। আয়াজ একমনে তাকিয়ে থাকলো প্রিয়তার দিকে। হঠাৎ বলে উঠল,
‘নেমে দাঁড়ান প্রিয়তা।’
প্রিয়তা না বুঝতে পেরে আয়াজের চোখে তাকালো। আয়াজ পুনরায় একই কথা আওড়াল।
‘বাহিরে নেমে দাঁড়ান।’
অবুঝের মত প্রিয়তা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতে শব্দ করে গাড়ির ডোর বন্ধ করে দিল আয়াজ। জোর শব্দে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। কিছু বোঝার আগেই শো করে গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল আয়াজ। খাবার প্লেট হাতে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। পরক্ষণে অপমান আর খারাপ লাগায় চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো পানি। আয়াজের এমন ব্যবহার তীব্রভাবে আঘাত করল প্রিয়তার আত্মসম্মানকে। এই পুচকে ছেলের এত কিসের দাপট? রাগে মুখশ্রী লাল হয়ে এলো। বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে নিঃশব্দে মেইন গেট লক করে নিজের ফ্লাটে চলে এলো সে। রাতে আর ঘুম হলো না। রুমের বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে বসলো প্রিয়তা। ধোঁয়া ওঠা কাঁপে চুমুক বসাল। তার মুখে আঁধার ছেয় আছে। তার গভীরতা এই রাতের আঁধারকেও হার মানাবে। প্রিয়তা নিজের বিহেভে অবাক হলো। সে কি বদলে যাচ্ছে? এই যে সে আয়াজের উপর রাগ করার চাইতে বেশি মন খারাপ করছে। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? তার এখন উচিত ঝটপট আয়াজকে তার সকল সাইট থেকে ব্লক করে দেওয়া। কিন্তু সে তা না করে দেবদাসের মতো চা খেয়ে শোক পালন করছে। দেবদাস! মেয়েরাও দেবদাস হয়? নাকি দেবদাসি!
প্রিয়তা আবারো চায়ের কাপে চুমুক বসাল। তার এভাবে আয়াজকে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। ছেলেটা দিনকে দিন চরম বিয়াদপ হয়ে যাচ্ছে। সবটাই শাসনের অভাব!
প্রিয়তা আড় চোখে ফোনের দিকে তাকালো। নাহ এখনো কোনো টেক্সট বা কল আসেনি। প্রিয়তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অভিমান হলো খুব। একটা মেসেজ দিলে কি এমন হতো?সূউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা বাড়িটা প্রিয়তার ভিষণ পছন্দ হলো। বাড়ির সদর দরজা পেরোতেই সামনে পিচদেওয়া সরু রাস্তা। যার দুধারে বাহারি গাছের সমারোহ। দুতলা বাড়িটার অধিকাংশ জায়গা থেকেই রং খসে পড়েছে। বাড়িটায় যে বহুদিন ধরে রঙের আচর পরেনি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রিয়তার বেশি পছন্দ হলো ছোট্ট শান বাঁধানো পুকুর ঘাটটা। টলমলে পানিতে তাকালে নিজের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যায়। এতবড় বাড়িটা এই ভর দুপুরেও কেমন ঝিমিয়ে আছে। প্রিয়তা যখন এসবে বিভোর তখন আয়াজ কিছুটা রসিকতা করে বলল,
‘ আপনার নিজগৃহে আপনাকে স্বাগতম প্রিয়।’
‘হুম?’
‘কিছুনা। ভিতরে চলুন।’
আয়াজ হাসে। প্রিয়তা ছোট ছোট চোখে তাকায়। আয়াজ কেন হাসলো সে বুঝতে পারেনা। তবে তার এখন কেমন কেমন লাগছে। সেদিন রাতের ঘটনার পর দুদিন তার সাথে আয়াজের কোনো যোগাযোগ ছিল না। না আয়াজ তার খোঁজ নিয়েছছ আর না সে নিয়েছে। তবে হুটহাট করেই মন খারাপের মেঘ ছেয়ে যেত। চোখের জল ঝড়েছে কয়েকবার। কখনো বা ভিষণ রকম জেদ চেপে বসতো মাথায়। এই পিচ্চি অভদ্র ছেলের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। পরক্ষনেই হু হু করে কেঁদে উঠত মন। তাকে ভুলে থাকাটা এত বেদনার কেন?
আজ প্রিয়তা দুটো ক্লাস করিয়ে ছুটি নিয়েছে। মনের সাথে সাথে শরীরটাও ভিষণ খারাপ। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাসের জন্য দাড়াতেই সেখানে আয়াজের আগমন ঘটে। পরনে তার থ্রিকোটার প্যান্ট এবং হাফ হাতার টিশার্ট। প্রিয়তার বুকের ভেতর দামামা বেজে ওঠে। ছেলেটা এত আকর্ষণীয় কেন? এই যে তার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে! তার ভেতর পুষে রাখা রাগ গলে যাচ্ছে। প্রিয়তা চোখ সরিয়ে নেয়। এই অভদ্র ছেলের দিকে দ্বিতীয়বার তাকাবেনা সে। আয়াজ এগিয়ে এলো। প্রিয়তার শাড়ির আঁচল তুলে মুখ মুছল। প্রিয়তা হকচকাল। চোখ বড় করে বলল,
‘কি হচ্ছে আয়াজ! লোক দেখছে তো!’
আয়াজ আশপাশে তাকালো। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোক কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে। আয়াজ মিষ্টি করে হাসলো। মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,
‘মুখের ঘাম মোছার জন্য বউয়ের আঁচল বেষ্ট। তাই না চাচা?’
লোক দুটো কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। প্রিয়তা চোখ গরম করে। তবে আয়াজ পাত্তা দেয় না। প্রিয়তার পিছু পিছু বাসে ওঠে। বাস থেকে নামার পর এক প্রকার হুমকি ধমকি দিয়েই সে প্রিয়তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। যদিও প্রিয়তাকে এভাবে ধমকে আনা সহজ ছিল না আয়াজের পক্ষে। শাকিলা বেগম কল করে বলায় প্রিয়তা রাজি হয়েছে। তা দেখে আয়াজ প্রিয়তাকে খোঁচাতে বাদ রাখেনি। দুষ্টু হাসি দিয়ে ছোট ছোট করে বলেছিল,
‘কি ভেবেছিলেন? একা বাসায় আপনায় হরণ করতে নিয়ে যাচ্ছি? আপনার ভাবনাগুলোতো ভিষণ দুষ্টু প্রিয়! আপনাকে দেখে তো বোঝা যায় না এত দষ্টু চিন্তা নিয়ে ঘুরছেন!’
প্রিয়তা চোখ কপালে তুলে তাকায়। মুখের কি ভাষা ছেলের! একদম রসাতলে চলে গিয়েছে ছেলেটা!
বর্তমানে আয়াজদের লিভিংরুমে বসে আছে প্রিয়তা। তার সামনের টেবিল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রকম খাবার। তার শরীরের তাপ বেড়েছে কিছুটা। কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। খুব ছোট থেকেই অসুস্থ হলে সে খেতে পারে না। খাবার দেখলে বমি বমি পায়। এখনো তার ভিন্ন কিছু নয়। তবুও প্রিয়তা এক টুকরো আপেলে ছোট ছোট করে কামড় বসাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর শাকিলা তাকে তাড়া দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। প্রিয়তা অসহায় চোখে আয়াজের দিকে তাকায়। কিন্তু আয়াজ তার দিকে নজর দিল না। সে তো সোফায় আধশোয়া হয়ে গেইম খেলায় ব্যস্ত।
‘আপনিই কি আমার হতে চলা ভাবী?’
কন্ঠস্বর অনুসরণ করে বা দিকে তাকায় প্রিয়তা। ছিমছাম গঠনের একটা ছেলে হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফুটবল। পরনে জার্সি। মুখমন্ডল ঘর্মাক্ত। মাত্রই মাঠ থেকে খেলে ফিরেছে। প্রিয়তা ভিষুম খেল। খুকখুক করে কেশে উঠলো। শাকিলা বেগম ব্যস্ত হলেন। এগিয়ে এসে পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরলেন। আয়ানকে চোখ রাঙালেন। আয়ান ঠোঁট উল্টে ভাইয়ের দিকে তাকালো। আয়াজ কপালে ভাঁজ ফেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান মুখ কালো করে বলল,
‘কি করেছি আমি? এভাবে কেন তাকাচ্ছো সবাই?’
কথা শেষ করে পরপর প্রিয়তার দিকে তাকালো আয়ান। মুখ ভার করে শুধাল,
‘নট ফেয়ার ভাবী। কতটা এক্সাইটেড ছিলাম আমি তা তোমার চিন্তা ধারণার বাহিরে। ভেবেছিলাম তুমি আমার পার্টনার হবে। আমরা দুজন মিলে এ বাড়িকে ছোটখাটো একটা সার্কাস বানাব। কিন্তু প্রথম দিনেই তুমি আমার শত্রু বনে গেলে! এটা সত্যিই বেদনাদায়ক।’
আয়ান অসহায় মুখ করে চলে গেল। প্রিয়তা গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল কেবল। শাকিলা হেসে জানালেন,
‘ওর কথায় কিছু মনে করো না। ও আয়াজের ছোট চাচ্চুর ছেলে। আয়ান। ভিষণ দুষ্টু।’
প্রিয়তা হাসলো। সে জানে না ঐই মুহূর্তে কি বলা উচিত তাই হাসিকেই উত্তর হিসেবে বেছে নিল সে। শাকিলা আবারো বললেন,
‘দেখো তোমায় ঢেকে এনে এখন নিজেই ব্যস্ততা দেখাচ্ছি। কিছু মনে করো না। আজ বাড়িতে কেউ নেই। রিতাও তার বাবার বাড়িতে।’
প্রিয়তা হেসে বলল,
‘কোনো ব্যাপার না আন্টি। আমি আপনাকে হেল্প করি? কাজ করতে করতে নাহয় গল্প হবে।’
শাকিলা বেগমের মুখ উজ্জ্বল হলো। মেয়েটার অমায়িক ব্যাবহার তাকে মুগ্ধ করেছে। কি ভিষণ মিষ্টি মেয়েটা! যেন কোন স্বর্গদূত! শাকিলা বেগমের ভিষণ আফসোস হলো। কি হতো যদি মেয়েটার বয়স আর একটু কম হতো? প্রিয়তাকে দেখলে তার বয়স বোঝা যায় না ঠিক। প্রিয়তাকে তার পছন্দ হয়েছে এটাও ঠিক। তবুও তার মনে একটু খচখচানি রয়েই গেলো। মেয়েটা যে তার ছেলের থেকে পাঁচ বছরের বড়! আয়াজের বাবা কি এই সম্পর্কে সম্মতি দিবেন?
গ্রীষ্মের শেষ প্রায়। প্রকৃতি হুটহাট নিজের রূপ বদলে ফেলছে। কখনো ভিষণ রোদ কখনো বা ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি। বর্তমানে আকাশে মেঘ করেছে। ভিষণ রকম অন্ধকার। বাতাস বইছে শো শো করে। ভাব এমন যেন এখনি বৃষ্টি নামবে। ভাসিয়ে দিবে
এ ধরণীকে। কিন্তু প্রিয়তা জানে বৃষ্টি হবে না। থেমে যাবে কিছুক্ষণের মাঝে। মেঘ কেটে সূর্যি মামা উঁকি দিবে। হেসে বলবে,’হাভ সাম ফান?’
প্রিয়তার কথা সত্যি হলো। মেঘ কেটে গেছে। উজ্জ্বল আলোয় ছেয়ে গেছে সর্বত্র। প্রিয়তা সরল হাসলো। গুনগুন করে গান ধরলো। আজকাল তার খুব সুখ সুখ অনুভব হয়। মাজা অবদি ছড়ানো চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে খোপা বাঁধলো। মনে পড়লো আয়াজ তার চুল দেখে বলেছিল,
‘চুল সামলাতে নিশ্চই আপনার ভিষণ কষ্ট হয় প্রিয়? বিয়ের পর আপনার চুল সামলানোর দায়িত্বটা আমি নিয়ে নিলাম। এই সামান্য কটা দিন নাহয় একটু কষ্ট করে নিন।’
প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে হাসি মিলল। আয়াজের কথা মনে পড়লে আজকাল তার ভিষণ লজ্জা লাগে। কেমন করে যেন তাকায় ছেলেটা। একদম বুকে এসে লাগে। প্রিয়তার ফোন বেজে উঠলো। প্রিয়তা ব্যস্ততা দেখালো না। ফের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে উঠলো। ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানা থেকে ফোন তুলে নিল। ফোনের ট্রেনে আজের নাম্বর ভেসে উঠেছে। প্রিয়তা আয়োজন নাম্বার সেভ করেনি। সেভ করার মতো উপযুক্ত কোনো নাম সে আয়াজকে দিতে পারেনি। তবে নম্বরটা তার ভিষণ পরিচিত।
‘এত দেরী কেন হলো প্রিয়তা?’
‘চুল বাঁধছিলাম।’
‘আচ্ছা।’
এরপর নিশ্চুপ। কিছুসময় পর আয়াজ আবার বলল,
‘একটু বের হতে পারবেন?’
‘যদি বলি না তবেকি বের হতে মানা করবে?’
‘দুঃখীত। না বলে কোনো অপশন আপনার বরাদ্দ নেই। রেডি হয়ে নিন। টাইম থার্টি মিনিট।’
কল কেটে গেছে। প্রিয়তা ফিচেল হাসলো। অতঃপর বসে গেলো পোশাক বাছাইয়ের জন্য। আজকের এই সুন্দর পরিবেশে তাকেও সুন্দর লাগা চাই।’আয়াজ আমার কাছে কিছু ঠিক লাগছে না। প্লিজ পাগলামি করো না।’
‘আপনি আমায় ভালোবাসেন প্রিয়তা?’
প্রিয়তা আয়াজের চোখে তাকালো। ছলছল চোখে মাথা উপরনিচ করলো। আয়াজ জোরে শ্বাস নিলো। বলিষ্ঠ হাতে প্রিয়তার হাত আঁকড়ে ধরল। আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘আমরা খারাপ কিছু করছি না প্রিয়। আমরা আমাদের সম্পর্ককে হালাল করছি। নিজেদের সম্পর্কের একটি পূর্ণতার রূপ দিচ্ছি। কেন অযথা ভয় পাচ্ছেন? আমিতো আছি।’
আয়াজের কথা শুনে প্রিয়তাহু হু হু করে কেঁদে ফেলল। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল,
‘আমি তোমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছি আয়াজ। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা। একদম চাই না।’
আয়াজ মুচকি হাসলো। আলতো হাতে মুছে দিল প্রিয়তার চোখ। ফিসফিস করে বলল,
‘আমাকে যেন না হারাতে হয় তার ব্যবস্থাইতো করছি।’
‘কিন্তু..’
‘হুসসহ। কোনো কিন্তু না। ভেতরে চলুন। যত লেইট করবেন আমাকে হারানোর সম্ভাবনা তত বাড়তে থাকবে। রিস্ক নিতে চান?’