শূন্যতা

দরজায় বার বার কড়া নাড়ছে কেউ।শব্দটা যেনো অন্তির মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে।ছয় ঘন্টার ট্রেন জার্নি আর এরপর বাস জার্নির পর একটু যে রেষ্ট করবে তার উপায় নেই।এখন জামা চেন্জ করার মাঝেই বার বার ডাক পরছে তার।

photo of multicolored abstract painting

চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি (১ম পাট)

দরজার ওপাশ থেকে চার বারের মতো আবারও কথা গুলো রিপিট হচ্ছে

-আপু জলদি আয়।মামা মামি কিন্তু রেগে যাবে,প্লিজ জলদি বের হো।

-বলে দে আসছি।(অন্তি খুব বিরক্তি নিয়েই কথাটা বললো)

-আপু দরজাটা খোল প্লিজ।এখন আমি একা ফিরে গেলে মামার রাগী চোখ আমি দেখতে পারবো না,প্লিজ বের হো।

-প্রিয়া আমি আসছি।

-আপু

এরপর আর কোনো শব্দ নেই।

-অন্তি রেডি হয়েছো???জলদি আসো।

গলাটা শুনেই অন্তির কেমন যেনো বুক কেপে উঠলো ভয়ে।বিছানাটা গুছিয়ে,উড়না দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে দরজার কাছে আসলো।

-অন্তি।

-আব্বু আসছি।কাপা কাপা গলায় উত্তর করলো অন্তি।

-প্রিয়ার সাথে আসো।দরজা খোলো প্রিয়া ভেতরে যাবে

-জী আব্বু।

অন্তি দরজা খুলতেই হাসি মুখে প্রিয়া ঘরে ঢুকলো

-মামা তোমরা রেডি হয়ে যাও,আমি আর অন্তি আপু রেডি হয়ে আসছি।

-আচ্ছা।

এটুকু বলেই অন্তির বাবা চলে গেলো।

-আপু জানিস ই তো মামা কেমন রাগী তুই প্লিজ একটু ওদের মতো করে চল।

-আমার আর ইচ্ছা করে না প্রিয়া।

-আমার বড়ো বোনের বিয়ে।আর আমার মা এখনো মামাকে দেখে কাপে এই বয়সেও।বোঝ তাহলে মামা কতো রাগী।

-আব্বুর সাথে আমি আবার আগের মতো সহজ হতে চাই প্রিয়া।

-আপু।

-জানিস একটা সময় আমি একছুটে আব্বুকে জড়িয়ে ধরতাম,আব্বু সাথে গল্প করতাম,টিভি দেখতাম,আব্বু আমাকে খাইয়ে দিতো।এখন আব্বুর সামনে দাড়াই তবে মাথা নিচু করে,খেতে বসে পানি দিয়ে ভাত গিলে খাই,আর টিভি যে কতো দিন দেখি না তার হিসেব নেই।আড্ডা বলতে এখন শুধু পড়াশুনা নিয়ে কথা হয়।

প্রিয়া অন্তির হাত ধরে অন্তির মুখের দিকে তাকালো।একদম শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। প্রায় ছয় মাস পর অন্তির সাথে দেখা হলো প্রিয়ার।লাস্ট চার বছর ধরে অন্তির ফ্যামিলি চট্টগ্রাম শিফট হয়েছে।এরপর অন্তির আর ঢাকা আসা হয় নি।বিভিন্ন অকেশনে অথবা আত্নীয়দের মাঝে কেউ বেড়াতে গেলে তবেই অন্তি তাদের দেখা পেয়েছে।

-আপু একটু সেজে বের হো।

-ইচ্ছে নেই রে।

-আপু মামি বার বার করে বলে দিয়েছে তোকে যেনো সাজানো হয়।

-আজব বিয়ে তো পুনম আপুর আমি কেনো সাজতে যাবো।আর আজ তো বিয়েও না।জাস্ট মেহেন্দি আর সংগিত।

-আমি কিভাবে বলবো বল।আমাকে যা বলেছে তাই তোকে জানালাম।

ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটু সাজলো অন্তি।জরজেড কামিজ বরাবরই তার অপচ্ছন্দ তবুও মা সিলেক্ট করে দিয়েছে বলে এই কেটকেটে লাল জামাটা পরলো।চোখে হালকা কাজল আর ঠোটে একদম হালকা নুড শেডের একটা লিপস্টিক দিয়ে চুল গুলো দুপাশে ছেড়ে দিলো। হাতে একটা মোটা ব্রেসলেট পরে চশমাটা চোখে দিয়ে প্রিয়াকে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো অন্তি।

পুনম অন্তির ফুপির বড় মেয়ে।এম.বি.এ কমপ্লিট কয়েছে মাস দুয়েক আগে।মনের মতো কাঙ্খিত পাত্র পেতেই যেনো হাত ছাড়া করতে চাইলেন না কেউ।ঝটপট বিয়ের ব্যবস্থাটা করলেন পুনমের বাবা মা।

অন্তির এমন গেস্ট এ গিজ গিজ করা বাড়ি খুব অপচ্ছন্দ।আগের অন্তির সাথে এই অন্তির যেনো আকাশ পাতাল পার্থক্য।কেমন ভীতু,চুপচাপ,ইন্টোভার্ট টাইপের হয়ে গেছে মেয়েটা।একা একা অন্ধকারে চুপচাপ গুটিশুটি হয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে তার।সারাদিনকার কথা বলার একমাত্র সঙ্গী পিহু।অন্তির পোষা বিড়াল।এইটাই একমাত্র জীবীত প্রাণী যার সাথে অন্তি মন খুলে সব বলতে পারে।

অন্তি আর প্রিয়া এসে অন্তির মা কে ঘেসে দাড়ালো

-মিসেস আহমেদ এই হলো আমার মেয়ে অয়ন্তি।আর অয়ন্তি ইনি তোমার আন্টি হয়।তোমার শরীফ আংকেল এর ওয়াইফ।

অন্তি কিছুক্ষন ভেবলার মতো তাকিয়ে থেকে মিসেস আহমেদ কে সালাম দিলো।ও ভালো করে শরীফ আংকেল কে এটাও চেনে না।তবে এই মহিলার সাথে তাকে তার মা কেনো পরিচয় করিয়ে দিলো অন্তি এটার কোনে উত্তর পেলো না।

মিসেস আহমেদ বেশ মনোজোগ দিয়েই মেয়েটাকে দেখছে

-মা তোমার পুরো নাম কি?(মিসেস আহমেদ বেশ আগ্রহ নিয়েই প্রশ্ন করলেন)

-জ্বি অয়ন্তি হাসনাত।

-বাহ বেশ মিষ্টি নাম তো।

-আমার ডাক নাম অন্তি।

মিসেস আহমেদ এবার অন্তির হাত ধরে অন্তির পরালেখা,ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সব কিছু একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন।অন্তির বাবা মার মুখে প্রশস্থ হাসি থাকলেও অন্তির কেমন যেনো অসস্থি লাগছে।কেউ অন্তিকে স্পর্শ করুক এটা কেমন যেনো ওর কাছে বিব্রতকর।আর এই মহিলাতো যথারীতি অন্তির আঙ্গুলের ভাজ ও পর্যবেক্ষন শুরু করেছে।

অন্তির মা মিসেস আহমেদের চোখ অনুসরন করেই বুঝলেন উনার চোখ অন্তির হাতের কাটা দাগের উপর,

হাসি হাসি মুখ করেই বললেন

-আর বলবেন না আপা মেয়ের আমার কাচের চুড়ি পড়ার শখ।এই যে কেমন একটা বিচ্ছিরি দাগ করেছে।

-পানসে মুখে আবার হাসি টেনে বলতে শুরু করলেন আমারো খুব ভালো লাগে কাচের চুড়ি, আর অন্তি বাচ্চা মেয়ে এই বয়সেই তো এগুলো শখ বেশি থাকে।আপনার মেয়েটা বেশ লক্ষি।

মিসেস আহমেদ যেনো অন্তিকে দেখে বেশ খুশি।এ যুগে এমন ভোলাভালা শান্ত মেয়ে যে আছে তার তা জানাই ছিলো না।

অন্তির বাবা বললেন,

-প্রিয়া ছাদে অনুষ্ঠান হচ্ছে।তুমি আর অন্তি ওদের সাথে অনুষ্ঠানে আনন্দ করো যাও এখানে সব বড়রা আছে।

-জী মামা।প্রিয়া খুব নিচু গলায় জবাব দিয়ে অন্তির হাত ধরে হাটা শুরু করলো।অন্তির পায়ের কাছে পিহু গুটিশুটি হয়ে বসে ছিলো এতোক্ষন। পিহুও অন্তিকে অনুসরন করছে।

লিফটের সামনে কয়েকটা ছেলের আড্ডা দেখে অন্তি লিফটের আগ্রহ আর দেখালো না।দুই ফ্লোর উপরেই ছাদ।তাই সিড়ি হলেও সমস্যা নেই।প্রিয়া খুব তোরজোড় করলেও অন্তি খুব ধীর গতিতে যাচ্ছে।

প্রিয়া বললো

-জানিস অন্তি আপু পুনম আপুর শ্বশুর বাড়ি হলো এই ফ্ল্যাট টা।(এক ফ্লোর উপরে এসেই প্রিয়া কথাটা বললো)

-মানে কি??তোদের উপর তালায়??

-হ্যা।বছর দুয়েক আগে ভাইয়া এই ফ্ল্যাট টা কিনে।আর কয়েক মাস আগে আপুর জন্য প্রস্তাব পাঠায়।প্রথমে একই ফ্লাটে বাবা বিয়ে দিতে না চাইলেও মা আর সু পাত্র হাত ছাড়া করতে চায় নি।

আসলে মা তো জানতো সবটা

অন্তি প্রিয়ার কথা গুলো শুনতে শুনতেই ছাদে চলে এলো।বাকি কথা আর শোনা হলো না।পুনমের দিকে তাকিয়েই একটা মিষ্টি হাসি দিলো অন্তি।

পুনম খুব মিষ্টি একটা মেয়ে একদম ছিপছিপে গরন।খাটো বা লম্বার মাঝামাঝি গরনের একটা মেয়ে।দুই হাত ভর্তি মেহেদি দিয়ে বসে আছে।অন্তি কে দেখেই কেমন মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসি দিলো।

অন্তি পুনমের গালের সাথে নিজের গালটা ঠেকালো।

পুনম বললো

-ভালো আছিস??

-আছি।তুমি ভালো তো?

-দেখছিস তো কেমন করে সং সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছে।

-বেশ লাগছে কিন্তু তোমায়।এমন খাদি শাড়িতেও যে এতোটা সুন্দর দেয়ায় জানতাম না।অন্তির গলায় কেমন একটা ভাব।হাসি মুখখানায় হাসিটা যেনো ফেকাসে।

-অন্তি কতোদিন থাকবি?

-বিয়ে পর্যন্ত হয়তোবা।

-ওহ।

ওদের কথা আর এগুলো না।পিহু অন্তির পায়ে খোঁচাচ্ছে।অন্তি কোলে তুলে নিতেই অন্তির হাতের উপর পিহু মাথা ছেড়ে চারপাশের মরিচ বাতির আলো দেখতে লাগলো।

এই পাশটায় কিছু মেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।কিন্তু ছাদের অপর পাশেই বর পক্ষের কিছু ছেলে পেলে গান বাজাচ্ছে আর যে যার মতো নাচছে।বর এতোক্ষন এইখানে থাকলেও কিছুক্ষন আগেই কোন এক জরুরি কাজে বাসায় গেছে।

মুহূর্তেই একটা আতশ বাজি বিকট শব্দ করে ফুটে গেলো।পিহু ভয়ে নেমে গেছে অন্তির কোল থেকে। ছুটে যাচ্ছে ছাদের ওই পাশটায়।

অন্তি চিন্তিত ভঙ্গিমায় প্রিয়াকে বললো,

-পিহু ওই দিকটায় চলে গেছে।কি হবে এখন

-কি হবে মানে।চল যেয়ে নিয়ে আসি

-আসলে হঠাৎ বাজি ফুটতেই ভয় পেয়ে গেছে তো তাই হয়তো।

অন্তির অভ্যাসটাই এমন হয়ে গেছে সাধারন কিছুতেই ভয় পেয়ে যাওয়া।পিহুকে ওদিক থেকে আনতে গেলে ওর বাবা যদি দেখে অথবা যে কোনো ভাবে জানতে পারে যে ছেলেদের পাশটায় অন্তি ছিলো।তাহলে তার আর রক্ষা নেই।

পিহুকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে পুনমের দিকটায় আসতে নিলে অন্তি দাড়িয়ে গেলো।আর তার সাথে প্রিয়াও।

অন্তি ঢোগ গিলছে।অন্তির মনের মাঝে একের পর এক কথা চলছে আর ও ঠাই দাড়নো।

“কেনো থমকে দাড়ালাম জানিনা।তবে এভাবে যে আরও কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকবো তা আমার মস্তিষ্ক আগে থেকেই জানান দিচ্ছে।” মনের মাঝে অন্তির কথা গুলো বেজে যাচ্ছে।

চোখ থেকে চশমাটা খুলে চোখ মুছে আবার চোখে পড়লো অন্তি।নাহ ভুল দেখে নি। আরশান!!!!!

আবার মনে প্রশ্ন জাগলো, “এতো দিন পর… এভাবে এইখানে??আচ্ছা ও এখানে কেনো???মানুষ তো অতীতকে আর চোখে দেখে আমার কেনো চোখ সরানোর সাহস টা হচ্ছে না।আমি জানিনা কেনো চোখটা ভিজে যাচ্ছে।এই ছেলেকে দেখে কেনো আবার সেই ধরাম ধরাম করে বুক কাপছে।পলক ফেলবো কি ফেলবো না এটার জন্যও যেনো মন সায় দিচ্ছে না।যেনো চোখ সরালেই নাই হয়ে যাবে। “

“নিশ্বাস টা এখনই আটকে যাচ্ছে আমার।চার বছর পর আজ আর চোখে চোখ মেলানোর শক্তি পাচ্ছি না।এতো এতো প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিবো আর আমার মনে জেগে উঠা প্রশ্নটাকে কিভাবে উত্তর করবো এই চিন্তাই যেনো মাথায় ভো ভো করছে।”

অন্তি দুকদম পিছিয়ে যেতেই প্রিয়ার সাথে হোচট খেয়ে পরতে যেয়ে যেনো সবার নজরে পরে গেলো।চোখে চোখ পরলো তার চার বছর আগে ফেলে আসা অতীতের সাথে।মুখ থেকে আপনা আপনি অস্ফুট শব্দে বের হয়ে আসলো-আরশান,শান”

প্রিয়া অন্তির বাহুতে হাত দিয়ে বললো,

-কি বির বির করছিস????চল।

-হুম।ওহ হুম চল।অন্তির ভাবনাগুলো থেমে গেছে।

আরশান আর ওর বন্ধুরা এদিকটায় নাচ টাইপ কিছু একটা করছিলো।ঠিক নাচ না।অনেকটা লাফালাফি পর্যায়ের কিছু একটা।কেউ একজন পড়ে যেতে নিলে সেদিকে আরশানের চোখ পরে।কিছুক্ষন সে দিকে তাকিয়ে থেকে আরশান আবার নাচে মন দিলো।যেনো এখানে ও এমন কিছুই দেখেনি যে ওকে থমকে দাড়াতে হবে।হয়তো হবে কিন্তু আরশান আর তাকালো না।

পুনমের পাশে বসে থাকলেও অন্তির অবাধ্য চোখ বার বার আরশানের দিকেই পরছে।এতোক্ষনে কোলাহল কিছুটা কমে এসেছে।বাইরের লোকজন সব চলে গেছে।কাছের কিছু লোকজন আর বাড়ির লোকেরা এখন ছাদে।

বর পক্ষের লোকজনও এখন ছাদে আছে কেউ কেউ।

হঠাৎ ই সবার মাঝে কেউ একজন বলে উঠলো

-এটা সংগিত অনুষ্ঠান কিন্তু কেমন যেনো সবাই গুটিশুটি হয়ে আছে।পানসে লাগছে।বরকে উদ্দেশ্য করে বললো।কোন গান বাজনা কি হবে না???

বর নিজে দাড়িয়ে গেলো।

এতোজনের মাঝে মোটামুটি চিৎকার করেই ডাকলো

-এই আরশান।আদ্র। কই তোরা??

কয়েক বার ডাকার পরও তাদের কোথাও পাওয়া গেলো না।অন্তির চোখ যেনো এদিক সেদিক খুঁজছে।

বড়রা এক পাশে বসে আছে

ছাদের দৈর্ঘ বরাবর এক পাশে কনে পক্ষের ছেলেমেয়ে অপর পাশে বর পক্ষের।

গোটা কয়েক বাচ্চা ছেলেমেয়ে কিছুক্ষন নাচলো।

অন্তির চোখ গেলো সিড়ির দিকে।সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে ফেলে দিলো আরশান। ছাদে একে একে আরশান,আদ্র,দীহান,সাদান আর তাদের পিছনে একটা মেয়ে প্রবেশ করলো।

অন্তির ভেতরটা আবার কেপে উঠলো।এই ছেলে সিগারেট কবে ধরলো কে জানে।অন্তি বড়দের দিকে একবার তাকালো।আবার মাটির দিকে।

আদ্র কাধ থেকে গিটার টা নামিয়ে হাতে নিলো।সাদান মিক্সার এ একটা টিউন প্লে করছে।

সেড টিউন শুনেই সবার হাসি মুখ চুপসে গেছে

“আমার সুরের বুকে কান্না লুকিয়ে থাকে

আমার চোখের কোনে নোনা ছবি আকে

আমার গল্প শুনে হয় আলোকিত উৎসব

গল্প শেষে আমি আঁধারের মতো নীরব

নিজেকে ঢেলে আমি কত সুখ দিলাম।

বোঝে না কেউ তো চিনলো না

বোঝে না আমার কি ব্যাথা

চেনার মত কেউ চিনলো না

এই আমাকে।”

অন্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরশানের দিকে।ছেলেটার মুখের সেই মিষ্টতাটা হারিয়ে গেছে।কেমন একটা জেদি লুকে তাকিয়ে আছে।অন্তির খুব অসস্থি হচ্ছে।ওদের সেপারেশন হয়ে গেছে চারবছর আগেই। এটাকে ঠিক ব্রেকাপ বলে না।পরিস্থিতির চাপে আলাদা হয়ে যাওয়া।কিন্তু অন্তি তো আরশানের চোখে অপরাধি।ও ছেড়ে এসেছে।ভুলা যায় না তবু যেনো সবটা ভুলে গেছিলো মেয়েটা। সব কিছু থেকে বেড়িয়ে আসছিলো একটু একটু করে।কিন্তু আজ আবার

“হাসতে দেখো গাইতে দেখো

অনেক কথায় মুখোর আমায় দেখো

দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা।”

আদ্রর হাত থেকে গিটার টা নিয়ে এক ধ্যানে বাজিয়ে যাচ্ছে আরশান।মনের ভেতরটা খুব উথাল পাথাল করছে।খুব ইচ্ছা ছিলো কোনো দিন দেখা হলে মেয়েটার কাছে নিজের অপরাধ জানতে চাইবে।কিন্তু আজ অন্তিকে সামনে থেকে দেখার পর আরশানের কেমন যেনো জেদ হচ্ছে।এখন অন্তি আর সেই দুই বিনুনি করা বাচ্চা মেয়েটা না।যার ভেতর চাঞ্চল্য ছিলো।এখন অন্তি অনেক ধীর স্থির।আরশান সব থেকে অবাক হচ্ছে এটা দেখে যে অন্তি আরশানকে দেখে একটুও কথা বলার ইচ্ছাও দেখালো না।এই অন্তিকেই একটা সময় এতো ভালোবেসেছিলো।ভাবতেই আরশানের রাগে চোখ জলছে।

“আমার গানে একা নির্ঘুম অনেক প্রহর

আমায় ছেড়ে জোনাকি ছেড়ে বিরাট শহর

ডাকার কথা জাগে ডাকেনি কেউ কাছে

নিঃসঙ্গ এই আমি পুড়েছি মনের আঁচে

আমার মাঝে আমি-ই যেন শুধু লুকাই।”

প্রতিটা লাইন যেনো অন্তির কলিজা পুরিয়ে দিচ্ছে।মাথা নিচু করে বসে আছে অন্তি।আরশান এই গানটা যে অন্তির জন্যই গাইছে তা অন্তির বুঝতে বাকি নেই।

-আপু তুই ঠিক আছিস??অন্তির হাত ধরে প্রিয়া বললো।

-আমি একটু বাসায় যাবো।

-কোনো সমস্যা??

-এমনি ভালো লাগছে না।

-দেখনা কেমন পেনপেনে একটা গান সিলেক্ট করেছে।বিয়ের বাড়িতে এই গানও হয় জানতাম না তবে যাই বলিস কন্ঠটা কিন্তু,আর দেখতেও।

অন্তি এক পলক আরশানের দিকে তাকিয়ে পিহুকে কোলে নিয়ে চলে গেলো।

অনেক দিন পর আজ অন্তি যেনো খুব কাদতে পারছে।এতোদিন চোখ জললেও পানি পরতো না।আজ যেনো চোখের পানির সাথে মনটাও হালকা হয়ে যাচ্ছে।

“হাসতে দেখো গাইতে দেখো

অনেক কথায় মুখোর আমায় দেখো

দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা।

বোঝে না কেউ তো চিনলো না

বোঝে না আমার কি ব্যাথা

চেনার মত কেউ চিনলো না

এই আমাকে।”

প্রথমে সবাই এমন প্রোগ্রামে এই গান শুনে হকচকিয়ে গেলেও আরশানের কন্ঠ যেনো সবার মনে গেথে গেছে।তাই সবাই করতালি দিলো।

আদ্রর হাতে গিয়ার টা দিয়ে আরশান উঠে গেলো।এতো মানুষের মাঝেও কেমন যেনো লাগছে।হয়তো অসস্থি অথবা রাগ।রাস্তার একধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে ছেলেটা।সিগারেট টা আঙ্গুলের ফাকেই জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

বালিশে মুখ গুঁজে উপুর হয়ে শুয়ে আছে অন্তি। পিহু চুপচাপ অন্তির পাশে বসে আছে। কেমন যেনো থমথমে একটা পরিবেশ।

অন্তির স্কুল ছুটির পর ও আর মিলি রোজ হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরে। ক্লাস সিক্স থেকেই একই স্কুল ওদের। ওদের প্রতি দিনের অন্যতম রুটিন হলো স্কুল গেট থেকে ঝালমুড়ি কিনে বাসায় যাওয়ার পুরো পথটা আড্ডা দিয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে খেয়ে যাওয়া। দুই বান্ধবী ক্লাসেও একই সিটে বসে। তবু যেনো সারাদিনেও তাদের গল্প শেষ হয় না। এই জন্য যে কতো বার “তোমরা কাল থেকে আলাদা সিটে বসবে”। এ কথাটা শুনতে হয়েছে স্যার ম্যাম এর কাছে তার হিসাব নেই।

দিনটা খুব গরমের। কেমন কাঠ ফাটা রোদ। রোজকার মতো অন্তি আর মিলি ঝালমুড়ি কিনতে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎই কেমন ঝরো হাওয়া বইতে শুরু করে দিলো।

পরিবেশ দেখে মিলি বললো

-অন্তি চল আজ আর ঝালমুড়ি না খাই। জলদি চল বাড়ি চলে যাই। দিনের অবস্থায় এখই মনে হচ্ছে ঝড় শুরু হবে।

অন্তি বললো,

-কিন্তু মিলি আমরা তো পাঁচ মিনিট দাড়িয়েছি আর একটু না হয় দাড়াই।

ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে দুকদম এগিয়ে আসতে না আসতেই ঝুম বৃষ্টি। মুহূর্তেই হাতের ঝালমুড়ি ভিজে গেলো আর সাথে ঝালমুঠির কাগজটা ছিড়ে মুড়ি গুলো রাস্তার উপর ছড়িয়ে গেলো। কেমন এক বিদঘুটে অবস্থা। অন্তি আর মিলি দুজনের ব্যাগ যেনো ভিজে না যায় দৌরে স্কুল গেটের সামনে আসলেও স্কুল ছুটির টাইম অনেক স্টুডেন্ট এর ভিড়ে না দাড়িয়ে কিছুটা সামনে এসে একটা গাছের নিচে দাড়ালো।

মিলি খুব বিরক্তি নিয়ে বললো

-তোকে বলছিলাম অন্তি শুনলিনা আমার কথা। বাসায় চলে যেতে পারতাম এর মাঝে। এখনও যেতে পারবো। চলনা দৌড়ে চলে যাই।

-তোকে বাসায় গেলে বৃষ্টিতে ভিজতে দিতো?

-আমার বৃষ্টি পেনপেনে লাগে। তবে ভিজতে চাইলে দিতো।

-আমায় দিতো না। কেমন না বল, আমার বৃষ্টি কত প্রিয় অথচ আমার বৃষ্টিতে ভেজা একদম এলাও না।

পায়ের কের্স এ বৃষ্টির পানি ঢুকে কেমন যেনো প্যাচপ্যাচে লাগছে অন্তির।

মুজা আর কের্সটা খুলে খালি পায়ে মাটিতে দাড়ালো অন্তি।

বৃষ্টি হলে বাতাসে কেমন যেনো একটা গন্ধ ছড়ায়। এই গন্ধটা অন্তির খুব ভালো লাগে। পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে পিচের রাস্তার উপর থেকে বালি ধুয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা অন্তি খুব উপভোগ করছে।

মিলি অন্তির কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো

-অন্তি দেখ তখন থেকে একটা ছেলে ভাঙ্গা ছাতা হাতে ঘুরঘুর করছে। বিষয়টা একদম কিন্তু ভালো লাগছে না।

অন্তি খেয়াল করলো একটা ছেলে সত্যি কেমন যেনো এদিক ওদিক ঘুরছে। আর এখন অন্তিদের দিকটাতেই আসছে

-মিলি আমার মনে হয় উনি কোনো প্রবলেমে পরেছেন।দেখ চেহারা টা কেমন যেনো দেখাচ্ছে।

ছেলেটা অন্তির সামনে এসে দাড়িয়ে বললো

-তোমার ব্যাগটা কি রেক্সিনের?

অন্তি আর মিলি একটু চোখাচোখি করে অন্তি উত্তর দিলো

-কেনো বলুনতো?

-আসলে আমার কিছু দরকারি কাগজ পত্র এই ফাইলে।(একটা গোলাপি ফাইল দেখালো।) হাতে ছাতাটাও বাতাসের তোড়ে ভেঙ্গে গেলো। একটা রিক্সাখোজা পর্যন্ত যদি ব্যাগে রাখতে।

-আসলে ব্যাগটা রেক্সিনের কিনা জানিনা।

-ওয়াটার প্রুভ তো?

-কি জানি?

ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড অন্তির দিকে তাকিয়ে আবার বললো

-তোমার বই পত্র ভিজবে না?

-না তো।

-হুম। আচ্ছা। ফাইলটা প্লিজ রাখো। আমি জাস্ট একটা রিক্সা জোগার করবো।

ছেলের এমন এটিটিউড দেখে অন্তি আর মিলি দুজনই হা করে দাড়িয়ে থাকলো

কয়েকমিনিটের মাঝেই বৃষ্টি কমে গেছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টিটা আর নেই। অন্তি আর মিলি ছেলেটার ফাইল দেওয়ার জন্য এখনও একি জায়গায় দাড়িয়ে আছে।বৃষ্টি কমেছে কয়েক মিনিট হলো। ছেলেটার আসার নাম নেই। মিলি বললো

-এটা কেমন লোকরে বাবা। নিজে সেধে ফাইল দিয়ে গেলে এখনো আসার নাম নেই। এই তার দরকারি কাগজের গুরুত্ব।

-এমন ছেলে আমি জীবনেও দেখিনি বাবা।

-হুম।

অন্তি তার স্কুল ড্রেসের স্কার্ট টার নিচের অংশ ধরে চিপে পানি ঝড়িয়ে মাথা উচু করে তাকাতেই দেখলো ছেলেটা দাড়িয়ে আছে।

ছেলেটা একটু অসহায় ভঙ্গিতে বললো

-জী আসলে রিক্সা পেতে দেরি হয়ে গেলো। ফাইলটা..

অন্তি ব্যাগ থেকে ফাইল বের করতে করতেই ছেলেটার চোখ অন্তির দিকে গেলো

“দুইসাইডে ঝুটি বাধা চুলগুলো পানিতে ভিজে কাধে লেপ্টে আছে। মুখের পাশে ছোট চুলগুলোও লেগে লেগে আছে। অন্তি হাত এগিয়ে ফাইল দেওয়ার সময় অন্তির মুখটাও ছেলেটার মাঝে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো। ছোট মুখটাতে সবার আগে যেটা চোখে পরে তা হলো বাদমি লেন্স আর ঠোটের একটু উপরে একটা তিল।”

গালের উপর জমে আছে ফোটা ফোটা পানি।

নিরবতা ভেঙ্গে অন্তি বললো

-আপনার ফাইল।

-জ্বি। থ্যাংকস। আমি আরশান রহমান।

-ওহ।

অন্তি বা মিলি কেউ আর কিছু বললো না। অন্তি কের্স জোড়া আংগুলে আটকিয়ে হাঁটা ধরলো। মিলি বললো

-তুইই বল অন্তি উনার পরিচয় জেনে আমরা কি করবো,আসছে নাম বলতে।

-বাদ দে তো। জানিস মিলি আমার না বৃষ্টির পর এই শান্ত প্রকৃতিটা খুব বেশি ভালো লাগে।

আরশানের কানে অন্তির বলা শেষ কথাটা আবছা শোনা গেলো

সেদিন বাসায় ফিরে অন্তির অনেক বকা শুনতে হয়েছিলো। স্কুল থেকে বাসা বড়জোর দশ মিনিটের পথ। বৃষ্টি থামার আরও অনেক পরে যাওয়ায় সেদিন ওর মা ওকে অনেক বকেছে। রাতে অবশ্য বাড়াবাড়ি পর্যায়ের জ্বর উঠে গেছিলো।

-অন্তি। এই অন্তি। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

মার ডাকে হঠাৎই অন্তির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কখন চোখ লেগে এসেছিলো অন্তির খেয়াল নেই। বিছানার পাশে পিহুও ঘুমিয়ে আছে।অন্তি উঠে বসলো।

মিসেস হাসনাত চিন্তিত হয়ে বললেন

-রাতে খেয়ে ঘুমাও। শরীর খারাপ করবে না হয়। তোমার বাবাও বকবে। ওদের প্রোগ্রাম এখনও শেষ হয় নি? আমি বরং খাবার দিয়ে যাই।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র আধাঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। এতো অল্প সময়ে মরার মতো পরে পরে কিভাবে ঘুমালো অন্তি নিজেও জানে না।

অন্তির মা একপ্লেট ভাত আর কয়েক টুকরা গোস্ত এনে সামনে রাখলো।

অন্তির চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে চোখ থেকে ঘুম ছাড়ে নি এখনো। তাই মিসেস হাসনাত নিজে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলেন। খাওয়ানোর এক ফাঁকে বললেন,

-অন্তি তোমাকে ঢাকায় কোথাও ভর্তি করলে কেমন হয়?

অন্তি হ্যা না কিছু না বলে গ্লাস থেকে কিছুটা পানি মুখে তুলে নিলো

-আম্মু আমি আর খাবো না।

-কিন্তু এখনো অনেক ভাত।

-আম্মু খুব খারাপ লাগছে।

-জামাটা পাল্টে শুয়ে পরো তাহলে।

মিসেস হাসনাত আর জোড়াজোড়ি করলেন না। অন্তি একটা পাতলা সুতির কামিজ পরে জানালা খুলে দাড়ালো।

জানালার গ্রীল ধরে একমনে ভাবতে লাগলো

-আমি যদি ঢাকায় ভর্তিও হতে চাই তবুও তোমরা আমার ইচ্ছর গুরুত্ব না দিয়ে নিজেরা যা ইচ্ছা করবে।শুধু শুধু আমার ইচ্ছা প্রকাশ কারাটাই বৃথা।

প্রিয়া অন্তির পাশে এসে দাড়াতেই অন্তি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো

-কিরে প্রোগ্রাম শেষ হলো??

-আর হলো, বাইরে যা ঝরো হাওয়া শুরু হয়েছে না। এই বুঝি বৃষ্টি নামে। তাইতো সবাই ছাদ ফাঁকা করে চলে আসলো।

-কই জানালার ধারে দাড়িয়ে তো বোঝা যাচ্ছে না।

-আপু এইটা তো আরেক ফ্লেটের সাথে এডজাস্ট তাই বুঝবি না। এই দিকে আস এখানে একটা খোলা বারান্দা আছে।

অন্তির হাত ধরে প্রিয়া একটা দরজা খুলতেই খোলা বারান্দা চোখে পরলো। কোমর পর্যন্ত রেলিং টানা।অন্তি এই রুমে এতোক্ষন থাকলেও এই দরজাটা কিভাবে ওর চোখে পড়লো না ও নিজেও জানে না। প্রিয়া বললো,

-আপু তুই বরং একটু থাক আমি ঝটপট ভাত খেয়ে আসছি। তুই খেয়েছিস তো???

-হ্যা। তুই খেয়ে আস।

অন্তি বারান্দায় কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলো। খেয়াল করলো একটা লোক এই ঝরো হাওয়ার মাঝেও রাস্তার অপর পাশে এই বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়েই পায়চারি করছে। ওপাশের রাস্তায় গোটা কয়েক সোডিয়াম বাতির আলোয় লোকটার চেহারা স্পষ্ট না দেখা গেলেও ওইটা যে অন্য কোনো প্রাণী নয়, একজন মানুষ, অন্তি তা এগারোতলা উপর থেকেই বুঝতে পারছে। লোকটা এভাবে পায়চারী করছে কেনো কে জানে।

বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকায় অন্তির শরীর বাইরের ঝরো হাওয়ায় ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। অন্তি রেলিং ধরে ফ্লোরে বসো পড়লো। রেলিং এ মাথা ঠেকাতেই মনটা আবার ভার হয়ে আসলো। আজ আবার আরশানের সাথে কেনো দেখা হলো। দেখা না হলে কি হতো। অন্তির মাঝে আবার তোলপার উঠতে শুরু করলো। বুকের এই এক একটা চিনচিনে ব্যাথা যেনো আরশানের জন্য জমে থাকা ভালোবাসাগুলোর বহিঃপ্রকাশ।

আরশানের সাথে মাঝে কয়েকদিন স্কুল ছুটির পর অন্তির দেখা হলেও আজকাল স্কুল শুরু হওয়ার আগে একবার স্কুল ছুটি হওয়ার পরে একবার রোজই দেখা হয়। এটা কোইনসিডেন্স নাকি ইনটেশনালি অন্তি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।

মেয়েদের একটা ক্ষমতা আছে। ওরা খুব করে বুঝতে পারে কোন ছেলে তার দিকে তাকাচ্ছে, আর চোখ দেখে বলে দিতে পারে মনের মাঝে কি মতলব ঘুরছে।

সেদিন অন্তি দুই বিনুনি দুই হাতে নিয়ে হেলেদুলে বাসায় ফিরছে। মিলি আসে নি স্কুলে।

এতোদিন যেনো এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলো আরশান।

অন্তি স্কুল গেট থেকে কিছু দূর এগোতেই পিছন থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে ডাকলো।

অন্তি দাড়িয়ে যেয়ে পিছন ঘুরতেই আরশান অন্তির পাশে এসে দাড়ালো।

অন্তি বললো

-জ্বী আমাকে বলছেন?

-হ্যা।

-কেনো বলুন তো? আমি তো আপনাকে চিনিনা। (ঢের চিনে, শুধু আরশানকে তা বুঝতে দিলো না)

-আরে ভুলে গেলে সেদিন বৃষ্টিতে আমি তোমাকে ফাইল রাখতে দিলাম।

-হবে হয়তো, (বলেই অন্তি হাটা ধরলো)

-তোমার জন্য ঝালমুড়ি এনেছিলাম।

-সরি আমি অপরিচিতো কারো কাছ থেকে কিছু খাই না।

-অন্তি।

-আচ্ছা আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে? আর এভাবে রাস্তায় বার বার ডাকছেন কেনো?

-নাম তো এমনিতেই জানা যায়।

-আপনি কি জানেন আপনার এই আচরনগুলো ইভটিজিং এর পর্যায়ে পরছে।

-তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি ইভটিজার?

-হ্যা।

-আমাকে দেখে কি তাই মনে হয় তোমার?

-অন্তি পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো আরশানের। মুখ বাকিয়ে উত্তর করলো “না ঠিক তা মনে হয় না” তবুও এগুলা ইভটিজিং।

আরশান অন্তির কথায় হেসে দিলো। একটা ছেলের হাসি যে এতোটা সুন্দর হয় অন্তি আরশানের হাসি না দেখলে জীবনে জানতই না। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অন্তি আবার হাটা ধরলো।

আরশান এখনো ওর পিছুপিছু হাটছে। অন্তি বললো

-দেখুন এইতো আমার বাড়ির সামনে এসে গেছি। কেউ দেখলে আমার খুব প্রবলেম হবে। আমি কোনো প্রবলেমে ফাসতে চাই না। আপনি দয়া করে যান।

-আমি তোমার জন্য কিছু এনেছি। তবে তা শুধু আজ বৃষ্টি হলেই প্যাকেটটা খুলে দেখবে আর না হলে ফেলে দিবে।

-মানে, আমি কেনো নিবো?

-অন্তি আমি বলেছিতো বৃষ্টি হলেই তা খুলে দেখবে।আর কাল সকালের আগে বৃষ্টি না হলে তা না দেখেই ফেলে দিবে। আর আমিও তোমাকে কখনও বিরক্ত করবো না।

-এটা কেমন কথা?

আরশান একটা কাগজের শপিং ব্যাগ অন্তির দিকে এগিয়ে দিলো। অন্তি না নিতে চাইলে অনেক

অনুনয় বিনয় করে অন্তির হাতে পেকেট গুজে দিয়ে চলে গেলো আরশান ।যাওয়ার সময়ও বার বার বললো বৃষ্টি হলেই খুলবে না হলে ফেলে দিও।

সেদিন অন্তি রাত আটটা পর্যন্ত বৃষ্টির অপেক্ষা করে পরতে বসলো। আর একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লো।পরতে পরতে আরশানের দেয়া পেকেট টার কথা অন্তির মাথা থেকেই বেড়িয়ে গেছে।

হঠাৎ ই বজ্রপাতের শব্দে অন্তি চমকে উঠলো ঘুম থেকে। জানালার পর্দাটা খুলেই ঘুমিয়ে গেছিলো। বজ্রপাতের ঝলকানি বার বার চোখে পড়ছে। অার সাথে ঝুম বৃষ্টি। অন্তি দ্রুত উঠে জানালা বন্ধ করে দিলো। বৃষ্টির ছিটা এসে টেবিলে রাখা দুই একটা বই ভিজে গেছে। বই গুলো ছড়িয়ে দিতে দিতেই অন্তির মনে পড়ে গেলে আরশানের দেয়া পেকেট টার কথা।বিকালে বাসার গেটে এসে পেকেট টা যেনো কারো চোখে না পরে তাই ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছিলো।

পেকেট খুলতেই অন্তি বিস্ময়ে হা করে থাকলো।একগুচ্ছ কদম ফুল মোরানো একটা সাদা কাগজ দিয়ে। সারাদিন শেষে ফুলগুলোর সাদা অংশটুকু কেমন যেনো একটা বাদমি রং ধারন করেছে। সাদা কাগটাতে অন্তি একটা চিঠি দেখলো। রুমের মাঝে যে কোনো সময় কেউ চলে আসতে পারে। বিশেষ করে ঝরের সময় তার মা আসতে পারে এই ভেবে ফুল গুলোকে একটু আরাল করে রুমের লাইট টা নিভিয়ে ওয়াশরুমে চিঠিটা নিয়ে ঢুকে গেলো।

“অন্তি,

কি বলবো জানিনা। আজ সকালে দেখলাম তুমি একা স্কুলে যাচ্ছো। মনে হলো আজই তোমাকে মনের কথা বলার সঠিক দিন। শুধু বিকালের অপেক্ষা,

অন্তি তুমি কি জানো? তুমি বৃষ্টি কন্যা।৷ তোমার নাম মেঘোবতী হলে বেশ হতো অথবা বৃষ্টিমালা। আমি যখন সেদিন বৃষ্টিতে তোমাকে প্রথম দেখলাম তাকাই নি ভালো করে। কিন্তু বৃষ্টি শেষে যখন তোমায় দেখলাম প্রকৃতির সেই স্নিগ্ধতা তোমার মাঝে আমি পেয়েছি।অন্তি আমি সরাসরি এটা বলতেই পচ্ছন্দ করবে যে আমি তোমার প্রেমে পরে গেছি ভালোবেসে ফেলেছি অন্তি।

তুমি যেহেতু চিঠির এটুকু পরে ফেলেছো তার মানে আজ বৃষ্টি হচ্ছে। আমি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে বৃষ্টির উপরই ছেড়ে দিয়েছি বৃষ্টি সহায় হলে তুমি জানবে আর তা না হলে কোনোদিনও জানতেও পারবে না আমার মনের কথাটা।”

অন্তি চিঠি থেকে চোখ তুলে মুখ বাকিয়ে মনে মনে বললো আমি এমনিতেও আপনার হাব ভাবে মনের কথা বুঝে গেছি।

আবার চিঠিতে চোখ ফেললো

“আমি উত্তরের অপেক্ষা করবো অন্তি। এই বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলটা তোমার জন্য।

আরশান রহমান”

অন্তি চিঠিটাকে আরো দুবার রিভিশন দিয়ে কুটি কুটি করে ফ্লাশ করে দিলো টয়লেটে।

ওয়াশরুমের দরজা খুলে গুন গুন করে গান করছে অন্তি

“-বাদল দিনের প্রথমও কদম ফুল করেছো দান “

বিছানায় তাকাতেই চোখে পড়লো অন্তির মা বিছানায় শুয়ে আছে। অন্তি কে দেখেই তিনি বললেন,

-এখনো ঘুমাও নি?

-আম্মু বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছিলো।

আর কথা না বাড়িয়ে অন্তি ওর মার পাশে শুয়ে পড়লো। মনে মনে ভাবলো এর আগে যা হয় প্রতি দিন সব তার মাকে ও জানাতো কিন্তু আরশানের সাথে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে আজকের সব কিছু কেনো অন্তি লুকাচ্ছে তার মার থেকে। উত্তরটা সে নিজেও জানে না।

সেরাতে অন্তি ঘুমিয়েছিলো ঠিকি কিন্তু আরশানের চোখের ঘুম উড়ে গেছিলো। বৃষ্টি হওয়ার আগে বৃষ্টি না হওয়ার চিন্তায়, আর বৃষ্টির পর অন্তির মনের কথা জানার চিন্তায়।

অথচও আজও কিছু উত্তর অন্তির অজানা। আরশান কি অন্তি ওকে ছেড়ে যাওয়ার পর নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছিলো? আচ্ছা আরশান নতুন কাউকে ভালোবাসলে কি অন্তির খুব কষ্ট হবে? চোখ থেকে কিছু পানি গড়িয়ে পড়লো অন্তির গালে।

প্রিয়া এসে ধপ করে অন্তির পাশে বসে পড়ে বললো,

-আপু তুই এখনো রুমে আসিস নি?

-না এখানে ভালো লাগছে।

-আজ প্রকৃতিটা অনেক সুন্দর মনে হয় বৃষ্টি হবে।

অন্তি নিচের দিকে তাকিয়ে পথে পায়চারি করা লোকটাকে আবার দেখতে পেলো

-আচ্ছা প্রিয়া ওই লোকটা এখানে অনেক্ষন ধরে পায়চারি করছে। এই ঝরো বতাসের মাঝেও।

কোন লোকটা?

প্রিয়া কিছুটা ঝুকে দেখলো লোকটাকে

-ওহ এই লোকটা? পাশের ফ্লাটের আন্টি বলেছে এই লোকের প্রেমিকার বিয়ের পর নাকি বর নিয়ে এই ফ্লাটে উঠেছে। চারতলায় থাকে উনার এক্স। প্রতি বৃহস্পতি বারই উনি এভাবে পায়চারি করেন এই টুকু জায়গায়।হয়তো একটু উনার প্রাক্তন কে দেখার জন্য।

অন্তি কিছুক্ষন অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো

-মেয়েটা অনেক আনলাকি উনার মতো কাউকে হারিয়েছে।

ভাগ্যটা কেমন যেনো দেখ এতো ভালোবেসেও মানুষকে আলাদা থাকতে হয়। যার প্রতি কোনো ফিলিংস নেই তার সাথে জীবন জুড়ে যায়। ভালোবাসাটা কেবলই যাতনা ময়।

আরশান মাঝরাতে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। গন্তব্য তার জানা। অন্তি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর যখনই অন্তির কথা মনে হতো আরশান রোজ অন্তির স্কুল গেটের সামনে এসে দাড়াতো। অন্তির স্কুল থেকে অন্তি যে বাসায় থাকতো সে বাসার রাস্তা পর্যন্ত পায়চারি করতো। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন অন্তি ঢাকার সাথে সাথে আরশানের জীবন থেকেও চলে গেলো। এরপর দরকারেও এ পথে আসা হয় নি।

উত্তরায় খুব একটা পানি জমে না। আরশান অন্তির স্কুল গেটের সামনে জুতা খুলে দাড়লো। পায়ে একটু পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন আগেই খুব জোর ঝড় হয়ে প্রকৃতিটা এখন একদম নিরব। স্কুলের সামনের রাস্তাটার দিকে আরশান কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাঁটা শুরু করলো।

অতীত গুলো আরশানের চোখে এখন ঝাপসা।

অন্তি কোনো ভনিতা ছাড়াই হুট করে একদিন আরশানের সামনে এসে বলেছিলো

-আপনি অনেক কিউট। আপনাকে আমার ভালো লাগে।

বিস্ময়ে যেনে আরশানের চোখ বড় বড় হয়ে গেছিলো। অবশ্য অন্তিকে এই অবস্থায় আনার জন্য আরশানের বেশ কাঠখর পুড়োতে হয়েছিলো। এর পেছনে আরশানের অনেক বেশি পাগলামিটাই খুব কাজে দিয়েছিলো। দিন দিন অন্তির ভালোলাগাটার পরিমাপ বেড়ে ভালোবাসা হয়ে গেলো।

সম্পর্কটা একটা গতি নিয়ে চলতে শুরু করেছে সবে। আরশান অন্তির ভেতর দিন দিন এতো এতো বিস্ময় কর বিষয় আবিষ্কার করছিলো যে আরশান নিজেও বিষম খেয়ে বসত।

অন্তিকে বেশির ভাগ সময় আরশান মেঘবতী বলেই ডাকতো। ততোদিনে অন্তি আরশানের নামটা ছোট করে শান বলে ডাকতে শুরু করেছে।

অন্তির দিনগুলো তখন রঙ্গিন ফানুসের মতো। কেমন রং ছড়িয়ে আকশে পাড়ি জমাচ্ছে। তার স্বপ্নগুলোও সাথে তাল মিলিয়ে দিনকে দিন পাহাড় সমান হচ্ছে।

ক্লাস নাইন এর শেষ থেকে মোটামুটি শান আর ওর রিলেশনটা শুরু হলেও টেনে উঠার পর সবাই জানলো অন্তির বয়ফ্রেন্ড আছে।

বিষয়টা অন্তির বাসায় পৌঁছাতেও যেনো খুব একটা সময় নিলো না।

অন্তির বাবা মা শুধু এটুকু জানে যে অন্তি আর মিলি স্কুল থেকে ফেরার পথে কোন এক ছেলেকে প্রায়ই তাদের সাথে দেখা যায়। অন্তির সাথে বেশি কথা হয়। তাই কি না কি মনে করে অন্তির বাবার সন্দেহের তীর টা মিলির দিকেই ঘুরে গেলো। পেশায় ব্যাবসায়ী হলেও উনার আচরন বরাবর ডিটেকটিভদের মতো। উনার মতে অন্তি যেহেতু প্রাণ খুলে কথা বলে তার মানে ও কালপ্রিট না। যে লোকের ভয় করে সেই দোষী। তবুও অন্তি তখন মোটামুটি নজর বন্দি। স্কুল থেকে এখন রোজ অন্তির মা নিয়ে আসে। স্কুলে যাওয়ার সময় রিক্সা করে দেয়।

প্রেম পাহাড়া দিয়ে আটকানো যায় না। ঠিক তাই। অন্তির উপর থেকে সন্দেহটা একটু হালকা হতেই মাসে পনেরো দিনের প্রাইভেট ক্লাসের জায়গায় বিশ দিনের রুটিন ধরিয়ে দিলো অন্তি তার মার হাতে।

খুব যাচাই বাছাই করেই বাকি দিন ঠিক করলো অন্তি। যে দিন অন্তির মা ব্যাস্ত থাকে অন্তির ছোট ভাই রুশ্যকে নিয়ে, বিশেষ করে বুধবার। এ সময়টা রুশ্যর এক্সট্রা কারিকুলার ক্লাশ। আর সপ্তাহের তিনদিন অন্তির বাবা ঢাকায় থাকলেও চারদিন ব্যবসার দরকারেই চট্টগ্রাম থাকে। রবি থেকে বুধ বার চট্টগ্রাম থাকেন তিনি। এই রুটিনটা ফিক্সট। অন্তি দিন আর সময় গুলো সেভাবেই গুছিয়ে নিলো। ঠিক বিকাল ৪ টা থেকে ৫ টা। আসা যাওয়া নিয়ে আরও ত্রিশ মিনিট। প্রায় দের ঘন্টা আরশান আর ও পুরো শহর সপ্তাহের এই একটা দিন চশে বেরাতো বাইকে করে।

বেশির ভাগ সময় তারা দিয়া বাড়িতে বেড়াতে যেতো। লোকজনের ভির একটু কম বটে বুধবারে। আরশান মুগ্ধ হয়ে অন্তিকে দেখতো। রোদের আলোয় অন্তির চুল গুলো কেমন যেনো লালচে আভা ছড়ায়। আরশানের মুগ্ধচোখের সামনে ছটফট করে কথা বলেযেতো এক অবাধ্য ষোড়শী।

এক শরৎশুভ্র বিকেলে আরশান অন্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই বললো

-অন্তি এই বর্ষায় তুমি নজর বন্দি ছিলে আর আমার সেকেন্ড সেমিস্টার। বর্ষা নিয়ে আমার একটা ফেন্টাসি আছে বুঝলে।

অন্তি চারপাশের কাশ ফুল মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো। যেনো ও মেঘের রাজ্যে নরম তুলোর মতো মেঘ গুলোর মাঝে হারিয়ে গেছে।

অন্তির নিরবতা দেখে আরশান আবার বললো

-এই অন্তি।

-হুম বলো।

-আমি চাই এক বর্ষায় তুমি আমি দুজন কোনো এক খোলা মাঠে দাড়িয়ে হাতে হাত ধরে ভিঝবো। ঝুম বৃষ্টি হবে। অথবা কোন ঝিলের বুকে নৌকায় থাকবো তুমি আর আমি। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা তোমায় ছুঁয়ে যাবে। আর আমি মুগ্ধতা নিয়ে দেখবো। তুমি নীলপেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে খোপায় পড়বে বেগুনী জারুল ফুল। জানো অন্তি বৃষ্টি যখন থেমে যায়, চার পাশটা কেমন যেনো স্নিগ্ধতায় ভরে উঠে। নীরব সবুজ। গাছের পাতাগুলো যেমন ঝুবঝুবে ভিজে থাকে ঠিক তেমনি তোমার খোলা চুলগুলো তোমাতে লেপ্টে থাকবে। তোমার চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে ফোটা ফোটা পানি পরবে। নাকের ডগায় থাকবে শিশিরের মতো জমে থাকা পানি আর ঠান্ডায় থরথরে কাঁপা তোমার ঠোঁট।

-অন্তি নৌকার মতো ব্রু গুলো উচু করে আরশানকে প্রশ্নছুড়ে বসলো “আচ্ছা শান জারুল ফুল কোনটা?দেখতে কেমন?”

অন্তিকে আর জারুল ফুল দেখানো হয় নি। নীল পেড়ে সাদা শাড়িও কিনে দেওয়া হয়নি। এই ইচ্ছা গুলো আরশানের স্বপ্ন হয়েই থেকে গেলো। অন্তির সাথে আর কোনো বর্ষায় দেখা হয় নি। তার আগেই অন্তি আবারও বাসায় ধরা পরে গেলো। আর এবার তো বাসার বাইরে যাওয়াও বারন। আরশানকে অন্তির বাবা মা দেখেনি তবে প্রাইভেট থেকে আনতে যেয়ে মেয়েকে পেলেন না মিসেস হাসনাত।

সেদিন অন্তি ঠিক সময়েই ঘরে ফিরলো। কোনোকিছু বুঝতে আর যেনো বাকি রইলো না।

একে একে অন্তির এস এস সি শুরু হলো। পড়ালেখার চাপ বেড়েছে। তখন আরশানের সাথে কথা হয় ছোট্ট মুঠোফোনে। খুব লুকিয়ে, সবাই ঘুমিয়ে গেলে ওয়াস রুমে ঢুকে ফিসফিসিয়ে দুচার কথা।

পরীক্ষা গুলো ভালো খারাপ মিলিয়েই হলো। অন্তির বাবা মা সহজ সমাধান বের করলেন, মেয়েকে এপথ থেকে ফেরাতে হলে শহর পাল্টাতে হবে। স্বপরিবারে চট্টগ্রাম শিফট হয়ে গেলেন। এতে অন্তির বাবা সহজে ব্যবসাও দেখতে পারবে আর মেয়েকেও।

ঢাকা ছেড়ে আসার দিন আরশান অন্তিদের বাসা ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিলো। সেই কয়েক পলকের দেখা এখনো যেনো অন্তির চোখে দূর্স্বপ্ন হয়ে আসে।

খুব বাজে ভাবে অন্তির ঘুমটা ভাংলো। প্রিয়া অন্তিকে ডেকে তুললো। চোখ খোলার পর প্রিয়া চেহারাটা দেখে অন্তি কিছুটা ঘাবরে যেয়ে বললো

-কি হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?

-আপু কাল রাতে যে লোকটি পায়চারি করছিলো উনি বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। রাস্তার ঠিক ওই ল্যাম্প পোষ্ট টার নিচেই পরে আছেন।

অন্তি চশমাটা কোনো ভাবে চোখে দিয়ে উরনা পেচিয়ে দৌড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো।

নিচে অনেক মানুষের ভীর। লাশের চারপাশে পুলিশ বেস্টনি।

অন্তির হাত পা কেমন জানি কাঁপছে। কাল রাতেও লোকটাকে জীবন্ত চলাফেরা করতে দেখলো। আর এখন নীথর দেহটা পরে আছে।

ফ্রেশ হয়ে বের হতেই পুনমকে দেখলো বিছানায় বসে বসে কাঁদছে।

অন্তি পুনমের পাশে বসে বললো

-কাঁদছো কেনো আপু??

-এমন দিনে এমন একটা অলুক্ষনে বিষয়।

-তুমি এসব বিশ্বাস করো। লোকটা মারা গেছেন। তার আয়ু ছিলো এতোদিন।

প্রিয়া কথা টেনে বললো

-এভাবে ভালোবেসে পাগলের মতো রোজ ছটফট করার থেকে মারা গেছেন এই ভালো।

পুনম যেনো প্রিয়ার কথায় খুব চটে গেলো। এ কেমন কথা একটা মানুষ মারা গেছেন।

কিন্তু প্রিয়ার কথাটা অন্তির বুক চিড়ে অনেক গভীরে পৌছালো।

মনের মাঝে একা একাই শব্দ যুদ্ধ শুরু হলো,আরশানও কি এভাবে ছটফট করেছিলো সেদিন?

মনে মনেই অন্তি বললো “আরশান আমায় ক্ষমা করে দিও”। অন্তির ভেজা চোখ টা মুছে নিলো।

বিকালের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টালো। সন্ধ্যায় গায়ে হলুূদ। এর মাঝে হলুদের স্টেজ করা হলো। রংবেরং এর কাগজ আর কাপর দিয়ে পুনমদের বাসার সামনের মাঠ টুকু সাজানো হলো।

সন্ধ্যায় মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। পুনম আর অভির গায়ে হলুদ এক সাথেই তবে দুইজনের স্টেজ দুটো।মাঝখানে নেটের পর্দা টানা।

গায়ে হলুদেও যে এতো মানুষ আসতে পারে অন্তির জানা ছিলো না। কনে পক্ষে যতো না মানুষ বর পক্ষের মানুষে গিজগিজ করছে।

বরপক্ষের কিছু মেয়ে এসে পুনমকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে গেলো।

এক মেয়ে তো অতিরিক্ত নেকামি করে বললো,

-ওফ আই লাভ দিজ প্রোগ্রাম। ব্রাইডাল শাওয়ার ইজ মাই ফেভরেট পার্ট অফ এনি ওয়েডিং।

কথাটা শুনেই প্রিয়া ফিক করে হেসে দিয়ে মুখ বাকিয়ে বললো

-আই লাভ টু সি দেট টাইপ অফ মেকআপ লাইক আ আ, আচ্ছা অন্তি আপু পেত্নির ইংরেজি কি?

-আহ প্রিয়া কি হচ্ছে, শুস, একদম চুপ।

-বুঝেছি তুমিও পেত্নির ইংরেজি জানো না।

ছেলেকে হলুদ দিতে এসে প্রিয়া, উরশী আর পুনমের কিছু বন্ধু বান্ধবি বরের স্টেজে বসলেও অন্তি একটু সাইড হয়ে দূরেই দাড়িয়ে দেখছিলো সবটা। লচোখ দুটো কিছু একটা খুঁজছে।

অস্ফুট বেলি ফুলের একটা মালা অন্তির বরাবর কেউ একজন এগিয়ে দিতেই অন্তি তাকালো সেদিকে

-শান(খুব নিচু গলায় অন্তি বললো)

-ভয় পেয়ে গেলে? আমায় খুজছিলে?

-না (মাথা নিচু করে অন্তি জবাব দিলো)

-কিন্তু আমায় যে বললো তুমি আমায় খুঁজছিলে

-কে?

-ইউর আইস।

অন্তি আর কোনো জবাব দিলো না। আরশান এখনো কতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। আচ্ছা আরশান কি অন্তি কে ক্ষমা করে দিয়েছে নাকি অন্য কিছু। অন্তি যেনো আর ভাবতে পারছে না। তার আগেই চোখ পানিতে ভরে গেলো।

আরশান আবার নিরবতা ভেঙ্গে বললো,

-খোপায় ফুলটা পরো পরিপূর্ণ লাগবে। (হাতে রাখা বেলির মালাটা এগিয়ে ধরলো আরশান)

-লাগবে না।

-জানি তো। মানুষটাকেই আর লাগে না। তার দেয়া ফুল, অতি নগন্য কিছু একটা।

আরশান ছুড়ে ফেলেদিলো মালাটা।

অন্তি এবারও কোনো জবাব দিলো না।

আরশান রাগী গলায় বললো,

-এই মেয়ে তুমি কি এখনো জামা কাপর গুছিয়ে রাখতে শিখো নি? শাড়ি সামলাতে জানোনা পড়েছো কেনো?

-মানে?

-কোমর দেখা যাচ্ছে। আর তুমি মানে জিঙ্গেস করছো?

-অন্তি আঁচল টেনে কোমর ঢেকে নিলে। এমন একভাজের শাড়ি অন্তি কখনো পড়ে নি তাই ঠিক ভাবে সামলে উঠতে পারে নি। কিন্তু আরশানের ধমকে একদম চোখ থেকে পানি ঝরে গেলো অন্তির।

প্রিয়া অন্তিকে পাশে না পেয়ে আশেপাশে তাকাতেই কিছু দূরে দেখলো কাল যে ছেলেটা গান করেছিলো তার সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে

প্রিয়া উঠে এসে অন্তির পাশে দাড়াতেই খেয়াল করলো অন্তি কান্না করছে।

প্রিয়া অবাক হয়ে বললো

-আপু এনি প্রবলেম?

-না। আমি একটু বাসায় যাবো।

-কিন্তু,

-আমার ভালো লাগছে না।

প্রিয়া আর কথা বাড়ালো না

অন্তি একবার আরশানের দিকে তাকিয়েই প্রিয়ার সাথে চলে গেলো।

অন্তিকে রুমে রেখেই প্রিয়াকে ছুটে যেতে হলো হলুদ অনুষ্ঠনে।

মেয়েটা রুমে একা একাই হাসফাস করতে লাগলো। এই ছেলেটা বারবার কেনো চোখের সামনে আসছে কে জানে।

অন্তি মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে মাথাতেও একটু পানি দিলো। আরশানের চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে।

আরশান যথেষ্ট লম্বা। আগের তুলনায় একটু সাস্থ্যও বেড়েছে। এখন যেনো খুব বেশি আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। গাল ভরেছে ছোট ছোট দাড়িতে আর সেই রাগী চোখ। অন্তির যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে।এতোদিন না হয় অন্তি সবটা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে। এখন চোখের সামনে আরশানকে দেখে আবার সব সংযম যেনো হারিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষন চোখ বন্ধকরে বসে থাকলো অন্তি। এরপর শাড়িটা খুলতে যাবে এই সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো।

বিয়ে বাড়ি। সবাই গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম নিয়ে অনেক ব্যাস্ত। ঘরে এখন শুধু অন্তি।

আচলটা ঠিক করে দরজা খুলেই অন্তি অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,

-কাউকে খুজছেন?

-আমি কি ভেতরে আসতে পারি?

অন্তি এবার মেয়েটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। জিন্স টিশার্ট পড়া একটা মেয়ে। চুলে বয়কাট দেয়া, বা পাশের কানটাতে কালো এয়াররিং লাগানো, হাতে একগাদা ব্রেসলেট, গলায় চোকার। হাব ভাব পুরোটাই ছেলে ছেলে। অন্তি ভেতরে ঢুকতে দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতেই মেয়েটা বললো,

-তুমি কি অয়ন্তি?অয়ন্তি হাসনাত?

-হ্যা। আমায় চেনো কিভাবে?

-আমি নুন।

নুন নামটা শুনেই অন্তি কিছুক্ষন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

-ভেতরে আসো।

নুন কোনো ভনিতা ছাড়াই ঘরে ঢুকে গেলো। আরশানের মুখে এই মেয়েটার কতশত গল্প যে শুনেছে অন্তি তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

অন্তি এখনো কিছু বলছে না। ওর যেনো কথা বন্ধ হয়ে গেছে। নুনকে কি আরশান পাঠিয়েছে? নুন ওকে কিভাবে চিনলো? নুন কি কোনো উত্তর চাইবে আজ? আর অন্তি নিজেও নুনকে দেখেনি কোনো দিন। আরশানের কাছে অনেক বার নুনের গল্প শুনেছে শুধু। অন্তি চিন্তা করতে করতে নুনকে বসতে বলার কথাও ভুলে গেছে।

নুন কোনো সংকোচ না করেই বিছানায় বসে গেলো।

অন্তির দিকে তাকিয়ে নুন বলতে শুরু করলো,

-ভাইয়া সবসময় বলতো তোমার চোখ আর ঠোঁটের উপরের তিলটা সুন্দর কিন্তু কখনও তো বলেনি তোমার ডান পাশে একটা গেজ দাঁত আছে। তোমার চেহারাটা কিন্তু মারাত্মক। আমিতো ছবিতে দেখেছিলাম তোমার মুখটা লম্বাটে। কিন্তু বাস্তবে একদমই অন্যরকম। বেশ মিষ্টি দেখতে তুমি(এক দমে কথাটা শেষ করলো নুন)

-অন্তি নুনের কথা শুনে একটু হাসলো।

-তুমি জানো তোমার হাসিটাও সুন্দর। আর তোমার চুলগুলো। আই উইশ আমার যদি এতো এতো চুল থাকতো তোমার গুলার মতো।

অন্তি নুনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো

-তুমিও অনেক কিউট।কোন ক্লাসে এবার তুমি?

-এস এস সি শেষ করলাম।জানো আমার একটুর জন্য গোল্ডেনটা কেটে গেলো।

-আহা! মন খারাপ করো না।

-আমি সহজে মন খারাপ করি না।

-বাহ! বেশ তো, তা তুমি আমাকে কিভাবে চিনলে?আগে তো কখনও আমাদের দেখা হয় নি।

-বলবো তবে রাগ করবে না তো?

-বলো, রাগ করবো কেনো?

নুন বলতে শুরু করলো

-আসলে তুমি ভাইয়াকে সহ্য করতে পারো নাতো, তাই যদি ভাইয়ার ব্যাপারে বললে রাগ করো তাই।

-আমি রাগ করবো না। তুমি বলো। (অন্তির মনটাও ছটফট করছে আরশানের খরব শুনতে)

নুন অন্তির হাত দুটো ধরে বললো,

-ভাইয়া কাল যখন প্রোগ্রামে ওই গানটা করছিলো তখনই খটকা লেগেছিলো। এমন গান এমন প্রোগ্রামে বেশ বেমানান ছিলো। তার চোখ অনুসরন করে দেখলাম ও তোমাকে দেখছে। এরপর তুমি যখন উঠে চলে গেলে তখন আরও বেশি সন্দেহ হলো।

আচ্ছা তোমাকে তো ভাবি ডাকার অধিকার নেই তাই আপুই ডাকি। জানো আপু তুমি যখন চলে গেলে ভাইয়াকে ছেড়ে ও কেমন যেনো হয়ে গেছিলো। কারো সাথে মিশতো না। বাসার সবার সাথে রাফ ব্যবহার করতো। এমনকি বাবার সাথেও। যখন ওর খুব মন খারাপ থাকতো, আম্মুর কোলে মাথা রেখে কাদতো।আম্মুও কাদতো।

নুনের কথা গুলো সহজ সাবলীল। তবুও অন্তির বুকের মাঝে প্রতিটা কথা খুব করে আঘাত করছে।

অন্তি এবার নুনের হাত ধরে বললো

-আমি অনেক বড় অপরাধী নুন। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু চাইনি।

নুন আবার বলতে শুরু করলো

-ভাইয়া তোমার চলে যাওয়ার ধাক্কাটা সামলাতে পারে নি। তখন পর পর দুটো সেমিস্টার ড্রপ করেছিলো। আমরা ভেবেছিলাম ভাইয়া এতোদিনে সবটা সামলে উঠতে পেরেছে..কিন্তু কাল যখন তোমার সাথে দেখা হলো এর পর থেকে ভাইয়ার আচরন কেমন যেনো হয়ে গেছে। অনেকদিন পর কাল রাতে ভাইয়া আম্মুর কোলে মাথা রেখে কেদেছে। আম্মু অনেক কারন জিঙ্গেস করেছে কিচ্ছু বলেনি। কাউকে না বলেই মাঝরাতে বাসাথেকে বেড়িয়ে গেছিলো।

ওর রুমে পোড়া গন্ধপেয়ে আমি আর আম্মু যেয়ে দেখি অনেক গুলো চিঠি আর তোমার একটা ছবি অর্ধেক পোড়া অবস্থায় পরে আছে।

অন্তি এখন আর তার চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না।

নুন অন্তির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো

-আজ আবার ভাইয়াকে দেখলাম তোমার সাথে কথা বলতে। আমার মনে হলো আমার তোমার সাথে কিছু কথা বলা দরকার, আমি জানিনা কেনো তোমার সাথে কথা বলতে আসলাম। শুধু মন বললো তাই। ভাইয়া জানলে হয়তো আমাকে মেরেই ফেলবে।

অন্তি ফুপিয়ে কাদতে লাগলো। আরশানকে দেখে যতোটা স্ট্রং মনে হয়েছিলো অন্তির, ছেলেটা ভেতরে ভেতরে ততটাই ভেঙ্গে আছে। এখনো নিজেকে সামলাতে পারে নি।

নুন অন্তির মুখে হাত দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো

-কেনো করেছিলে এমনটা বলো আপু? আমার তোমাকে দেখে কেনো যেনো অনেক ইনোসেন্ট লাগছে। বলোনা কেনো করেছিলে? আমার ভাইটাকে একা ফেলে কেনো গেছিলে?

অন্তি চুপটি করেই থাকলো। চোখের পানিটা মুছে নুনের দিকে তাকিয়ে বললো

-থাকনা সেসব কথা, নুন যা চলে গেছে তা নিয়ে না ভাবাই ভালো।

-কিন্তু আপু আজ আমি সবটা জানতে চাই।

-নুন আমি বলতে পারবো না(অন্তি মিনতি করে বললো)

-কিন্তু,

নুন আবার বললো

-বলবে না তো। ভাইয়ার কসম। এবার বলো। আমি জানি তুমি এবার চুপ থাকবে না। বলো।

অন্তি অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো নুনের দিকে।

নুন আমি চট্টগ্রাম যাওয়ার পর আমাদের একদমই দেখা করা বন্ধ হয়ে গেলো। আর রোজ ওয়াশরুমে লুকিয়ে দুয়েক মিনিট কথায় যেনো আমরা দুজনই হাপিয়ে উঠেছিলাম। সম্পর্কটা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছিলো দিন দিন। টুকিটাকি কথায় ঝগড়া লাগতো। কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম না।

আমাদের মাঝে সেদিনও ঝগড়া হলো। আমি ওকে সময় দিতে পারিনা, ঠিক ভাবে কথা বলতে পারিনা এসব নিয়েই কথা কাটাকাটি।ফোনটা অফ করে টেবিলে বইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তবে ভাগ্য খারাপ হওয়ার ধরা পরে গেলাম।

জানো নুন সেদিন জীবনের প্রথম আব্বু আমার গায়ে হাত তুললো। অনেক অনেক মেরেছে আমায়।(অন্তির কান্নার জন্য কথা গুলো খুব অস্পষ্ট শোনাচ্ছে)

রাতে আব্বু ফোন অন করে আরশানকে কল দিয়ে লাউড স্পিকার অন করে আমার হাতে ফোন দিলো। আর আরশানকে বলার জন্য শিখিয়ে দিলো কিছু কথা।আমি বলতে চাইনি। তবে আমাকে বাধ্য করা হলো।

আমার এখনো আরশানের বলা কথা গুলো কানে বাজে। ওকে যখন ছেড়ে যাওয়ার কথা বললাম, ওর আকুতি গুলো এখনো আমাকে ঘুমাতে দেয়না নুন।

নুন অন্তিকে হালকা জড়িয়ে ধরলো। অন্তি আবার বলতে শুরু করলো।

-এরপর তিনদিন ফোনটা অন রেখে আব্বুর কাছেই রাখলো। এর মাঝে আরশান হাজার বার কল করেছে। ওই তিনটা দিন আমি ওয়াশরুমে গেলেও আম্মু আমার সাথে থাকতো। আর তিনদিন পর আবার আমাকে দিয়ে আব্বু আরশানকে বলালো “যেনো আমাকে ও আর বিরক্ত না করে”। ফোনটাও আব্বু ভেঙ্গে ফেললো।

তিনদিন ফোন অন থাকলেও রিসিভ না করায় আরশানও এটা ভাবলো না যে আমি ধরা পরে গেছি, বরং এটাই মনে করলো যে আমি ইচ্ছা করে ওকে ছেড়ে এসেছি।

এরপর আব্বু করা গলায় বললো, “আমাকে বাবা ডাকতে হলে সব কিছু ভুলে যেতে হবে। আর সব কিছু নিয়ে থাকতে চাইলে আমাকে মেরে যেতে হবে”।

জানো নুন সেদিন আমার আর কিছু করার ছিলো না। মনটা ছটফট করছিলো আরশানের জন্য, আর শরীরটা বন্দি ছিলো আমার পরিবারে। বাসা থেকে সব ফোন সরিয়ে ফেলা হলো। আর আমাকে বন্দি করে রাখা হলো। কয়েকদিন তো কেউ আমার সাথে কথাও বলে নি। এমনকি আমার ছোট ভাই রুশ্যও না। ওকে কি বলবো আমার আম্মু নিজেও আমায় খাবার জন্যও ডাকে নি।

যখন একদম একা হয়ে গেলাম তখন সব কিছু আমার কাছে অনর্থক লাগছিলো।

আমি সুইসাইড করার চেষ্টা করলাম।

(অন্তি ওর হাতের উপর কাটা দাগটা দেখালো)

কিন্তু ভাগ্য এতোই খারাপ যে মরলাম না।

এরপর অন্তি আর কিছু বলতে পারলো না। হেচকি উঠিয়ে কাদতে লাগলো।

নুন অন্তিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেদে দিলো। ওর নিজেরও খুব কষ্ট লাগছে। ওর এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে, ও ভেবেছিলো আরশান একা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু অন্তিও কম কষ্ট সহ্য করেনি। আরশানকে সাপোর্ট করার জন্য ওর পরিবারের সবাই ছিলো। বন্ধুরা ছিলো কিন্তু অন্তি ছিলো একা। কতোটা কষ্ট সহ্য করেছে। আর ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে যেতেই মরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

নুন অন্তিকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

-আমাকে মাফ করো আপু। আমি তোমায় ভুল বুঝেছি।

অন্তিও নিজেকে স্বাভাবিক করে একটু শান্ত হয়ে বসলো।

নুন বললো

-আপু ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।ভাইয়া রাজি হয়ে গেলেই বিয়ে।

অন্তি মুহূর্তেই কথাটাকে হজম করতে পারলো না।ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকলো।

নুন বললো

-আপু আমার মনে হয় ভাইয়ার ভুলটা ভাঙ্গানো উচিত।

-কি হবে এতে? আমি চাই ও আমাকে ভুলে থাকুক।আমার পরিবার কোনোদিনও ওকে মেনে নিবে না। আরশান নামটা আমার বাবা একদম সহ্য করতে পারে না।

-ভাইয়া ভালো জব করলেও না?

-না। সম্পর্ক মেনে নেওয়ার মতো মেন্টালিটি নেই এই ফেমিলিতে। তার থেকে ও যদি দূরে থাকতে পারে থাকুক। আমি চাইনা ওর ভুল ভেঙ্গে যাক।

ও আমাকে মাফ করে দিলে আমি ওর থেকে দূরে থাকার শক্তি পাবো না, তার চেয়ে এই ভালো। নতুন করে কষ্ট বাড়াতে চাই না।

নুন আর কিছু বলতে পারলো না।

অন্তি আবার বললো

-নুন তুমি তো তোমার ভাইয়ার ভালো চাও তাইনা?

-হ্যা।

-আমায় ছুঁয়ে কথা দাও এর একটা কথাও তুমি ওকে জানাবে না। ও যতো দূরে থাকবে ততো ওর জন্য ভালো।

-কিন্তু,

-.ওকে পেতে গেলে আমার পরিবার হারাতে হবে। এটা আমি কখনও পারবো না। আর আমি ওকে ভালোবাসি। ওর খারাপ পরিনতিও আমি সহ্য করতে পারবো না। ও যদি সত্যটা জানে, ও আমাকে আবার চাইবে। তখন ফিরিয়ে দেওয়াটার ক্ষমতাটা আমার থাকবে না। আবার আমার পরিবারও ছাড়তে পারবো না।

অন্তির কথা গুলো নুন চুপচাপ শুনলো।

অন্তির গালে হাত রেখে বললো

-তুমি অনেক ভালো। আমি চাই তোমরা দুজনই যেভাবেই থাকো ভালো থাকো। আমার বন্ধু হবে?

-নুন বন্ধুত্বটা খুবই অনর্থক।

-তবুও।

-হুম।

হঠাৎই প্রিয়া রুমে এসে বললো

-অন্তি আপু মামা তোকে ডাকছে, জলদি আয়।

অন্তি আর নুন দুজনই প্রিয়াকে দেখে চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বসলো।

প্রিয়া বললো,

-ওই মেয়েটা কে?

-ওকে তুই চিনবি না।আমার এক ফ্রেন্ড এর ছোট বোন।

কেউ আর কিছু বললো না। অন্তি পাঁচ মিনিটের মাঝেই শাড়ি পালটে একটা কালো কামিজ পরে বেড়িয়ে পড়লো প্রিয়া আর নুনের সাথে।

পুনমের কিছু বান্ধবি ডান্স পারফর্ম করছে। বেশ নাচে মেয়ে গুলো। শাড়ি পড়েও এতো ভালো নাচতে পারবে ওরা অন্তি এটা ভাবতেই পাড়ে নি। পুনমের বেশির ভাগ বান্ধবি বেশ মোটা। তাই অন্তি এমনটা ভাবলেও এখন ও ভালো করেই বুঝলো মোটা হলেই যে নাচতে পারবে না এমন কিছু নেই।

অন্তির পাশে এসেই মিসেস আহমেদ দাড়িয়ে বললেন

-মেয়ে গুলো কিন্তু বেশ নাচতে পারে।

-অন্তি মিসেস আহমেদকে দেখে বললো”জ্বী আন্টি”।

-তোমার বিড়াল ছানাটা কোথায়?

-পিহু আজ রুশ্যর কোলে।আমি শাড়ি পড়ে ওকে সামলাতে পারি না তো তাই ওকে দিয়েছিলাম।

-ওহ। তোমার বিড়ালটা খুব সুন্দর।

অন্তির আর মিসেস আহমেদের সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না, তাই হ্যা না কিছু না বলেই নাচ দেখতে ব্যাস্ত।

মিসেস আহমেদ আবার বললেন

-এই মেয়ে তুমি কিন্তু বেশ ঘর কুনো। একটু সবার সাথে সাথে থাকবে। দেখবে বেশ লাগছে।

অন্তি কিছু বলতে যাবে এমন সময় অন্তি মা এসে মিসেস আহমেদ কে নিয়ে গেলেন আর অন্তিকে বললেন”অন্তি আমি বাসায় যাচ্ছি, তোমার বাবা রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম ব্যাক করবেন তাই আমি একটু গুছিয়ে দিয়ে আসি। তুমি প্রিয়ার সাথে সাথেই থেকো।”

নাচের কিছুক্ষন বিরতি রেখে সাবাই রাতের খবারটা সেরে নিলো এর মাঝেই। মাঠের একপাশে কিছু টেবিল চেয়ার বিছিয়ে খাবার খাওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।

অন্তি খাওয়ার শেষে প্রিয়ার সাথে এক কোনে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎই হাই বিটের গানের সাথে নাচ শুরু করলো কয়েকটা ছেলে। বিটের তালেতালে একবার মরিচবাতি গুলো জলছে আবার নিভছে। মুহূর্তে ই সবটা আলোকিতো হচ্ছে। মুহূর্তেই আধার, সবাই বেশ উপভোগ করছে।

অন্তি আর কিছুক্ষন থেকে প্রিয়াকে বলে বাসায় চলে যাওয়ার জন্য। মাঠ থেকে অনেকটা দূরে এসে বাসার কাছাকাছি আসতেই কেউ যেনো অন্তির হাত টেনে এনে দেয়ালের সাথে অন্তিকে চেপে ধরলো। এদিকটা মোটামুটি অন্ধকার আর বাসার পিছনের সাইড হওয়ায় রোড সাইডের লাইটের আলোও পড়েনা এদিকে। তবে বাসায় সাজানো মরিচ বাতি গুলোর হালকা আলোয় অন্তি ঠিক বুঝতে পারলো মানুষটা আরশান।

অন্তি আরশানের থেকে হাত ছাড়িয়ে চলে আসতে চাইলে আরশান অন্তিকে দেয়ালের সাথে আরও শক্ত করে আটকে ধরলো।

আরশান বললো

-ভয় পাও কেনো আমায়?

-অন্তি স্বাভাবিক গলায় বললো, ভয় পাওয়ার কি আছে।

-চলে যাচ্ছো যে।

-কেনো থাকবো

-আমার কাছে কেনো থাকতে চাওনা?

অন্তি আর কোনো জবাব দিলো না। নিজেকে মনে মনে শক্ত করে নিয়ে জবাব দিলো

-আমার ভালো লাগে না তাই। আর তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আশা করি ওই মেয়েকে নিয়েই সুখি থাকবে। আমাকে যেতে দাও।

-অন্তি আমি তো ভুলে গেছিলাম। কেনো আসলে?কেনো? কেনো কাল ওভাবে আমার দিকে তাকালে। তুমি জানো তোমাকে ভোলার জন্য আমি কতোগুলা রিলেশন করছি। অনেক গুলা। দুই হাত প্রশস্থ করে দেখিয়ে বললো-এত্তোগুলা

অন্তি এতোক্ষনে বুঝে গেছে আরশান মাতাল। ও নেশার ঘোরে এসব বলছে। এতোটা অবনতি হয়েছে ছেলেটার। অবশ্য এর জন্য অন্তি দ্বায়ী তা অন্তি ভালো করেই জানে।

অন্তি কড়া গলায় বললো

-শান সড়ো তুমি। আমাকে যাতে দাও।

-কেনো দেবো?

-শান তোমার হবু বউ দেখলে বাজে ভাববে।

-ও এখানে আসবে কোথা থেকে? জানো অন্তি ও সবসময় তোমার মতো হতে চায়। এই জন্যই সৃজাকে আমার দেখতে ইচ্ছা করে না। ওকে আমি এটাই বোঝাতে পারিনা যে তুই এমা ওয়াটসন হ আমার আপত্তি নাই কিন্তু অন্তি কেনো হতে যাবি? অন্তি তো অন্তি। ওর মতো হতে চাইলেই কি হওয়া যায়? ও তো মেঘবতী, বৃষ্টি কন্যা। জানো ওকে যদি সারাদিন পানিতেও চুবিয়ে রাখা হয় না কেনো ওর মাঝে সেই স্নিগ্ধতা টা আসবে না।

আরশান আবোল তাবোল একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। আর অন্তির ভয় লাগছে কেউ এভাবে ওদের দেখলে কি ভাববে। তাছাড়া আরশানকে কিভাবে এখান থেকে সরাবে এই সব চিন্তায় যেনো অন্তির মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে আর সাথে আছে আরশানের সেই স্পর্শ যা অন্তির স্নায়ুগুলো কে অবশ করে দিচ্ছে। আরশানের এই পাগলামি গুলো অন্তির মনটাকেই না অসংযমী করে তুলে!

বেশ কিছুক্ষন পরই আদ্র আরশানকে দেখে দৌড়ে আসলো। অন্তিও অপ্রস্তুত হয়ে গেছে আদ্রকে দেখে। কেননা এতোক্ষনে আরশান অন্তিকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আদ্র আর সাদান আরশানকে ধরে অন্তিকে ছাড়িয়ে নিতেই অন্তি একছুটে বাসায় চলে গেলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *