শূন্যতা (৩য় পাট)

এই তুমুল ঝড়েও এমন পাগলামির মানে হয় কোনো।ছেলেটা যে দিন দিন বেহায়াপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে অন্তি এই দুঃখে জীবন ত্যাগ করে দিতে পারলেও বেশ হতো। এতো জোড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তবুও অন্তিকে একচুলও নড়তে দিচ্ছেনা আরশান। কি চায় ও ঠাডা পরে মরুক দুজন নাকি প্রচন্ড ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে অন্তি। হুহ জীবনেও ধরবে না। পরুক ঠাডা।

অন্তি মনে মনে বেশ জলে পুড়ে হাজার খানেক গালি দিয়ে আরশানের দিকে ঘুরে দাড়াতেই অমনি যেনো কলিজার লাফালাফি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এটা তো আরশান না। ওই রাগী লাল চোখ। আসলেই কি রাগী?নাকি এই লোকের চোখই এমন। কতো কাল যেনো ঘুমায় নি। চেহারা বড্ড ক্লান্ত।তবে এই বৃষ্টি তে ভিজে অন্তি কেপে কেপে উঠছে। কোনো উপায় না পেয়ে বললো-ছেড়ে দিন না বিহন ভাই। আমি এমন বিজলি ভয় পাই। ছাড়ুন আমায়।বিহন বীরপুরুষ এর মতো করে হুংকার দিয়ে বললো-আমি আছি তো। কোনো বিজলি তোমায় ছোবে না অয়ন্তি হাসনাত। ভয় কিসে তোমার?অন্তি কাদো কাদো গলায় বললো-আপনিই তো আমার সবথেকে বড় ভয়।ছাড়ুন না, ছাড়ুন আমায়।ঘেমে নেয়ে একদম গোসল করে ফেলেছে অন্তি। এমন একটা বাজে স্বপ্ন দেখে অন্তির যেনো হাত পা কাপছে।ঢগঢগ করে এক গ্লাস পানি গিলে নিলো অন্তি। শুধু শুধুই এমন স্বপ্ন দেখে নিজেও লজ্জায় পরে গেলো মেয়েটা। সেদিন বিহন লিফটে হাত ধরার পর এই কদিন তো অন্তির সামনেও পড়ে নি। হয়তো সেই ঘটনায় বিহন ছেলটা লজ্জিত। মানুষের সাথে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যা সে না চাইতেও উত্তেজনার বশে হয়ে যায়।অন্তি বরং মনে মনে বিহনকে কয়েক দিন খুজেছে। ছেলেটা হয়তো খুব নার্ভাস তাই আর সামনে পড়ে নি। অন্তির কি উচিৎ নিজে যেচে কথা বলে ফেলা।একমনে ভেবে অন্তি উঠে বসলো।নাহ এই ছেলের সাথে অযথা কথা বলার দরকার নেই। বিহনের চোখে অন্তির জন্য কিছু একটা আছে।তাই কথা না বলাই ভালো। এমনি এমনি ছেলেটার মনে আর কোনো অনুভূতি জন্মাক অন্তি চায় না।চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো অন্তি। আরশানের সাথে অনেক দিন হলো দেখা হয় না। দেখা না হওয়ারও বিশেষ একটা কারন আছে।সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে হঠাৎই আরশান আর সৃজাকে অন্তি এক সাথে দাড়িয়ে কথা বলতে দেখে। এমন একটা পাবলিক প্লেসে এরা একসাথে এমন ভাবে দাড়িয়ে আছে যেনো হাত ছেড়ে দিলেই আরশান অথবা সৃজা কেউ একজন দৌড়ে পালাবে। এমন হাত ধরাধরি করে দাড়ানোর মানে হয়। যদিও আরশান খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।বরং সৃজাই যেচে হাত আকড়ে ধরে রেখেছে।অন্তিকে দেখেই আরশান সৃজার হাত ছুটিয়ে অন্তি রিক্সায় উঠার আগেই রিক্সা আর অন্তির মাঝে এসে দাড়ালো। অন্তির যেনো রাগে পায়ের তলা জ্বলছে। মাত্রই তো হাজার লোকের সামনে একজনের হাত ধরে প্রেমালাপ করছিলো এখনই এখানে এসে হাজির। অন্তি পানসে মুখে বললো-কি চাই?-অন্তি কিছু কথা ছিলো।অন্তি আগ্রহ না দেখালেও প্রিয়া কথা বলার সুজোগ করে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে দাড়ালো।আরশান অবলিলায় বলে গেলো-অন্তি মেডিটেশন, জিম সবগুলারই মূল কারন তুমি। কিন্তু দেড় মাসেও তুমি আমায় এতটুকুনি সুজোগ দাও নি। কথা বলেছো যেনো উপায় না পেয়ে এমন। আমি তোমার কথার প্রেক্ষিতে তোমার বাবার এমন রাগের দুটো কারন বের করেছি। এক, “তুমি তখন বেশ ছোট ছিলে। নাইন টেনে পড়তে। যদিও এযুগে নাইন টেনের ছেলে মেয়ে একদমই বাচ্চা না। তবুও ধরলাম তোমার বাবার মতে আমি তোমার বাচ্চা কালের ভুল।”দুই, “তুমি আমার জন্য তোমার বাবা মাকে মিথ্যা বলেছো দিনের পর দিন। অন্তি প্রেম যারা করে সবাই কম বেশি মিথ্যা বলে। তবুও এটাও একটা অপরাধ।”এছাড়া আমায় মেনে না নেওয়ার কারন আমি দেখি না। মেয়েদের আচরন বলে দেয় আমি যথেষ্ট সুদর্শন। তুমিও কিন্তু আর চোখে মাঝে মাঝে দেখো। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আমিও যথেষ্ট কুয়ালিফাইড। আর একস্ট্রা যেটা আছে সেটা তোমার জন্য অঢেল ভালোবাসা।অন্তির মুখে কোনো জবাব ছিলো না সেদিন। আরশান চলে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলো আমি অপেক্ষা করবো অন্তি আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন এরপর আর আমি তোমার সামনে আসবো না। ভেবে দেখো।অন্তি এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলো গরমেও সে ঘেমে যাচ্ছে বারবার। আরশান খুব জেদি। সত্যি যদি আর অন্তির সামনে না আসে। দেড় দুই মাসে ছেলটা অভ্যাস খারাপ করে ছেড়েছে। সারাদিন আগে পিছে আগে পিছে করে হুট করেই উধাও হয়ে গেছে। অন্তি জানে আরশান অপেক্ষা করে। রোজ আরশানের গাড়িটা ক্যাম্পাসের একটু সামনেই পার্ক করা থাকে তবুও আরশান সামনে আসে না। অন্তির খুব মন চায় সামনে থেকে দেখতে। আজ তেরো দিন। আরশান কি সত্যি আর দুদিন পর উধাও হয়ে যাবে?সকালে কড়া রোদ দেখে বের হলেও ক্লাস শেষে বের হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে একটা রিক্সা পাওয়াও অসম্ভব প্রায়। প্রিয়া আজ আগেই চলে গেছে।এই বৃষ্টির মাঝে কিছু একটা আছে। যা চুম্বকের মতো অন্তিকে টেনে এনে আরশানের গাড়ির সামনে দাড় কড়ালো।কাঁচের জানালায় টোকা পড়তেই আরশান দরজা খুলে অন্তির দিকে অবাক হয়ে তাকালো।আর প্রেজেনটেশন ছিলো। একটা কালচে পাড়ের খয়েরি শাড়ি পড়েছে অন্তি। শাড়ি হয়তো একটা মেয়েকে হুট করেই আবেদময়ী নারী করে তুলে।আরশান আর অন্তির চোখে কিছু কথা বিনিময় হলো
অন্তি ব্যাগটা পিছনের সিটে ছুড়ে দিয়ে আরশানের পাশে বসলো। এই ছেলে কখন বৃষ্টিতে ভিজলো কে জানে। শার্টটা গায়ে লেপ্টে আছে।দুজনেই চুপ। আরশান জানে আজ অন্তি জবাব দিবে, এখন শুধু অন্তির কন্ঠের অপেক্ষা।অন্তি শাড়ির আঁচল খাঁমচে ধরে বলতে শুরু করলো-প্রেমটা আমি হিসেব করে করতে চাই শান। তোমাকে পেলে আমার পুরোটাই চাই আর না হলে একটুও না। আমি মধ্যবিত্ত প্রেমিকা হতে পারবো না। আমার সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন থাকবে না। কোনো ভয় বা নিরাসা ছোবে না আমায়। হয় একে বারে পেয়ে যাবো নয়তো একটুকুও পাবো না। এই পেলাম এই হারালাম এমন খেলায় আমি পা বাড়াবো না।আরশান অন্তির চোখে তীক্ষ নজরে তাকালো। তার কি বলা উচিৎ? সে যেনো ভাব শূণ্য। মেয়েটা হঠাৎই বড়ো হয়ে গেলো না তো? কেমন কঠিন কথা সহজ ভাষায় বলে যাচ্ছে। আচ্ছা অন্তিকে কি ঢের সাহস জুগিয়ে বলেই দিবে, -অন্তি তুমি তো আমার রানী। তুমি উচ্চবৃত্ত পর্যায়েরও আরও উর্ধ্বে।নাকি এতোটা গেরান্টি না দিয়ে গলা নামিয়ে মিন মিন করে অন্তির গলার পাশে নিজের ঠোট ডুবিয়ে বলবে-অন্তি তোমাকে আমার চাই। চলো একসাথে সংগ্রাম করি। একসময় আমরা জিতে যাবো।নাহ আরশান কোনো জবাব না দিয়ে অন্তির মুখটা দেখতে লাগলো। রূপে মেয়েটার কোনো খাদ নেই। বৃষ্টিতে ভিজে ঠোঁট আর চিবুকের দুপাশটা নীল আভা দিচ্ছে। চোখের ঘন পাপড়ি ভিজে যেনো আরও গাঢ় দেখাচ্ছে। গালের দুপাশে লেপ্টানো চুল। গোছালো ভ্রু যুগলের সাথে আরশান নিজের কপাল ঠেসে ধরে বললো-এতো দেরি কেনো অন্তি। আমার বুঝি হারানোর ভয় করে না? এতো কিসের অপেক্ষায় রাখো? রানী হতে চাও তো? তবে আমি যোগ্য রাজা হয়ে এসেই তোমায় আমার রানী করবো।অন্তির গলায় আবেগ ধরে এলো। আরশানে হাত চেপে ধরে বললো -আর যদি কারাবন্দী হয়ে জীবন কাটাতে হয়। সামান্য প্রজা হয়ে যাই? রাজার রানী হওয়ার স্বপ্ন টা যদি বিচ্ছিরি কোনো রূপকথায় রূপ নেয়?আরশান অন্তির থেকে সরে এসে নিজের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে অভিমানি সুরে বললো-আমি মাস্টার লক করি নি। চাইলেই বেড়িয়ে যেতে পারো।অন্তির বুকে কেমন জানি চিনচিনে ব্যাথা। এই ছেলের প্রেমে পড়েছিলো দুটি কারনে। নেহাত বাচ্চা ছিলো কিনা তখন।আরশানের ডান গালের এক পাশে একটা তিল। আর ছেলেটার মাত্রা ছাড়া পাগলামি।পাগলামিটা এখনও আছে। তবে তিলটা দাড়িতে ঢাকা পড়েছে। তাতে কি?এছেলে এখন আরো বেশি পাগল করে অন্তিকে। ভ্রু ছুঁয়ে ভেজা চুলগুলোর এলোপাথাড়ি পড়ে থাকা দেখে অন্তির হাত যেনো নিশপিশ করছে। ইচ্ছা করছে গামছা দিয়ে মাথা মুছে দুই গালে হাত রেখে চোখে চোখ দিয়ে বকতে বকতে বলুক-এই ছেলে, এতো অযত্ন করো কেনো নিজের? ঠান্ডা লাগবে জানো না?তবে অন্তি অমন কিছু না করে বিষ্ময়ের সীমা পার করে দিয়ে আরশানকে জাপটে ধরলো।আরশান হাসলো বিশ্ব জয়ের হাসি।-অন্তি তুমি কি হিটলার আর ইভা ব্রাউনের ভালোবাসার গল্পটা জানো? পরিবার আর প্রেমের বোঝাপড়ায় মিলেনি। তবুও কিন্তু মৃত্যুর দু- এক ঘন্টা আগে তারা বিয়ে করেছেন। ছেড়ে যেতে কারন লাগে না। আর ধরে রাখতে চাইলে শুধু একটা কারনেই ধরে রাখা যায় অন্তি। সেটা ভালোবাসা।অন্তি আচলের পানি ঝরাতে ঝরাতে বললো-লাইলি মজনু, সিরি ফরহাদ সব উদাহরন রেখে এই উদাহরণ দিলে যে?-জানিনা। অন্তি আমি আজ আবার বৃষ্টির সাথে বাজি ধরেছিলাম।অন্তি আঁচলের কোনায় চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছতে মুছতে হা করে আরশানের দিকে তাকালো।-অন্তি আমি জানতাম কোনো এক বৃষ্টি আমাদের মিল করিয়ে দিবে। সেদিন তোমার থেকে আসার পর একটা দিনো আকাশ মেঘ করে নি। তা না হলে এতো ক্ষরার পর আজই কেনো আবার ঝুম বৃষ্টি হবে?আমি জানতাম অন্তি তুমি আসলেই বৃষ্টি হবে। প্রকৃতি স্নিগ্ধতা ছড়াবে। আর আমার বৃষ্টি কন্যা আমায় দেবে মুগ্ধতা।বৃষ্টি শেষে হলদে বিকেল আর সেই বিকেলের সোনালী আভা অন্তির মুখে ছড়িয়ে পড়ার মুগ্ধতা আরশানকে ১০৩° ডিগ্রি জ্বরেও প্রেম প্রেম অনুভূতিতে ডুবাচ্ছে।প্রিয়াদের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসার পরই গেইটের সামনে নুন এর সাথে অন্তির দেখা হয়ে গেলো। নুন ও ওর চাচার বাসা থেকে নিজেদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছে।অন্তিকে দেখেই নুন একপ্রকার দৌড়ে এসে অন্তিকে জড়িয়ে ধরলো।অন্তি এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না তাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নুনের দিকে তাকিয়ে বললো-ওহ তুমি?-হ্যা ভাবি। তো কি ভেবেছিলে কে এভাবে ধরবে তোমায়?অন্তি নুনের কথায় হেসে দিলো।নুন আবার বলতে শুরু করলো-কোথায় যাবে এখন?-ইউনিভার্সিটি। তুমি?-বাসায় যাবো। ভাইয়া অনেক অসুস্থ। বাসায় একা। আম্মু চাচার বাসায় জরুরি দরকারে আসলো আমি দিয়ে গেলাম। এখন ভাইয়ার কাছেই যাবো।-কি হয়েছে ওর? অন্তি অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো-এ মা। তুমি জানো না? কথা হয়নি ভাইয়ার সাথে? ওর তো অনেক জ্বর।বেশ কিছুদিন। এখনো সারে নি। কিন্তু ও যে ওই দিন বললো তোমাদের সব ঠিক ঠাক। এখন থেকে যেনো ভাবি ডাকি তোমায়।অন্তি কেমন যেনো অসস্থি বোধ করলো। কিছুটা লজ্জা মিশ্রিত ভঙ্গিতে বললো -আসলে আমি ফোন ব্যাবহার করি না। বিষয়টা খুবই সেকেলে লাগলেও আমি সত্যি কোনো ফোন ব্যবহার করি না।নুন অবাক হয়ে কিছুক্ষন অন্তির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-আজ কি জরুরি কোনো ক্লাস আছে?-সব ক্লাসই জরুরি নুন। আমি পড়ালেখাটা মন দিয়ে করতে চাই।-একদিন পড়া ফাঁকি দিলে কিছু হয় না। তুমি চলো তো আমার সাথে বাসায় আমি, ভাইয়া আর কাজের মেয়ে। ওকে বললে ও কাউকে কিছু বলবে না। তুমি এসুযোগে ভাইয়ার সাথে কথাও বলতে পারবে আর ভাইয়ারো ভালো লাগবে। চলো না প্লিজ।নুনের এমন জোড়াজুড়িতে অন্তি বিশেষ ইচ্ছে না থাকলেও ওদের বাড়িতে যেতে হলো। যদিও অন্তিও আরশানকে দেখার জন্য মন কেমন করছিলো। তবে কউকে না জানিয়ে। সবার অগোচরে এভাবে এ বাড়িতে আসাটা অন্তির কাছে চরম পর্যায়ের বিব্রতির কারন। গেটে পা রাখতেই অন্তির কেমন যেনো অসস্থি লাগছে। এতোদূর এসে কি ফিরে যাবে? নাকি একটা বার আরশানকে দেখেই যাবে। দুটানায় পরে গেছে অন্তি।এমন অসস্থিকর পরিস্থিতিতে পড়লে অন্তি প্রচুর ঘামে।হাত পা কাঁপে। আর বুকের মাঝে ধুকপুকানি এতো বাড়ে যে মনে হয় কেউ হাতুড়ি পেটা করছে। এখনও তার ব্যাতিক্রম হচ্ছে না।নুন অন্তির হাত টেনে এনে বাসার ভেতর ঢুকালো। আরশানদের বাসাটা ডুপ্লেক্স না হলেও দুতালার একটা খুব আকর্ষনীয় আর অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ সুন্দর গোছানো একটা বাসা।পুরো জায়গা জুড়ে অনেক রকম ফলের গাছ লাগানো বাসার চারপাশে। তবে তেমন ঝোপঝাড় নেই। সব পরিষ্কার। যেকোনো মানুষেরই এ বাড়িতে ভালো লাগবে। খুব নিরিবিলি।বাসার বাইরের পরিবেশ অন্তিকে যতোটা না মুগ্ধ করেছে তার থেকেও বেশি মুগ্ধ করেছে ভিতরের পরিবেশ। বসার ঘরটা এতো পরিপাটি, সব আসবাব পত্রেই আভিজাত্যের ছোঁয়া। অন্তি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতেই নুন গায়ের কটিটা খুলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো-ভাবি গো এই বাড়িতে তো সারাজীবন থাকবা। তখনও দেখতে পারবা। তখন দেখবা কেমন অসহ্য লাগে এমন সেকেলে পরিবেশে। এখন বরং ভাইয়াকে দেখবে চলো। যার জন্য এতো কষ্ট করে তোমাকে আনলাম।অন্তির বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। নুন হাত ধরে অন্তিকে আরশানের রুমের সামনে এনে দরজার সামনেই অন্তির হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলো।অন্তি আর আরশানের যেনো চোখে চোখে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। নুনও হতবাক। আরশানের পাশে সৃজা বসে আছে আর ঘরের আরেক কোনার সোফায় আদ্র আর সাদান। পুরো ফ্লোরে কাচের টুকরা আর সুপ ছিটে ছুটে পড়ে আছে।নুন অন্তির দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো। নুন এতোক্ষনে বুঝতে পারলো তার মা কেনো তাকে চাচার বাসা থেকে আসতে দিতে চাইছিলেন না।অন্তির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নুন বললো-সরি ভাবি। আমি জানতাম না সৃজা আপু এসেছে।অন্তি চোখার ইশারায় অভয় দিলো।-সৃজা তুই যা তো। তখন থেকে তোকে বলছি চলে যেতে।আরশান চোখে রাগি ভাব এনে কথাটা বলতেই সৃজা উঠে দূরে যেয়ে দাঁড়ালো।অন্তির উপস্থিতি যেনো আদ্র আর সাদান কে অনেক খুশি করলো। ওরা দুজনই জানে অন্তি আরশানের জন্য কি। সাদান মুখে প্রসস্থ হাসি এনে বললো-নে দোস্ত তোর জীবনজ্যোতি চলে এসেছে। এবার আমরা যাই।আদ্র আরশানের পিঠে হাত চাপড়িয়ে আস্তে করে বললো-শালা মাতলামি পাগলামি যাই করিস না কেনো ভাবিকে নিজের করে ছাড়লি তাহলে।সাদান আর আদ্র অন্তির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে উঠে চলে গেলো রুম থেকে। অন্তিও হাসি বিনিময় করলো কিন্তু দরজা পার করে আরশানের রুমে ঢুকলো না।সৃজাকে দেখে অন্তির কোনো হিংসে হচ্ছে না। কেমন যেনো অসহায় লাগছে সৃজাকে। অন্তির কি এখন সৃজাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেয়া উচিৎ নাকি মুখে বিশাল হাসি ঝুলিয়ে বিজয়িনীর বেশে ওর সামনে যেয়ে আরশানকে জয় করার বীরত্ব দেখানো উচিৎ? অন্তি দুটোর একটাও করলো না। বরং ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলো। এতো সুন্দর একটা মেয়েকে আরশান কেনো এতো অবহেলা করে? যে কেউ প্রথম দেখাতেই বলবে এই মেয়ে কতোটা মিষ্টি দেখতে। শরীরে জড়ানো মেরুন রং এর মসলিন কাপড়ের থ্রি পিসটা যেনো মেয়েটার রূপটাকে আলোকিতো করছে।আরশান নিরবতা ভেঙ্গে বললো-অন্তি ভিতরে আসো।অন্তিকে এর পরও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সৃজা এগিয়ে এসে অন্তির পাশে দাঁড়িয়ে বললো-ভেতরে যাও। আমার কিছু কাজ আছে আমি চলে যাচ্ছি।অন্তি সৃজার মুখের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকলো। এতো সহজে কেউ কারো উড বি কে তার প্রেমিকার হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারে? সৃজার চোখে অন্তি কোনো হতাশা আর অশান্তির খোঁজ পেলো না।অন্তির কেমন যেনো গলা শুকিয়ে আসছে।আরশান আবার বললো-অন্তি ভিতরে আসো।অন্তি ধীরপায়ে আরশানের রুমে ঢুকে সোফায় বসলো।আরশান কিছুটা ভ্রু কুচকে অন্তির দিকে তাকালো। ওই সোফায় বসার মানে কি?তবুও মাথা ঠান্ডা রেখে বললো-অভি ভাই বললো তুমি পুনম ভাবির বাসায় গেছো সকালে। ঝটপট অভি ভাইকে দিয়ে বলিয়ে মাকে পাঠালাম ওই বাড়ি আর নুনকে পাঠালাম মার সাথে যেনো ও মাকে রেখে তোমায় বাসায় নিয়ে আসে। কিন্তু মা আমাকে একা রেখে যাওয়ায় সৃজাকে ফোন করে পাঠিয়ে দিলেন আর আমি সৃজাকে দেখে আদ্র আর সাদান কে ডেকে আনলাম। একা বাড়িতে ওকে আমি কোনো সুযোগ দিতে চাইনি।কথটা মুহূর্তেই অন্তির ভেতরটা ঠান্ডা করে দিলো। এখনি অন্তির খুব কড়া কথা শুনাতে মন চাচ্ছিলো। অন্তি তো মনে মনে কথাও ঠিক করে নিয়েছিলো আরশানকে কড়া গলায় বলবে,”মিস্টার শান তুমি যদি মনে করো তোমার রানী থাকতেও আরও কারও সঙ্গ প্রয়োজন তবে আমি সেচ্ছায় বনবাস নিবো। তবু এসব অধর্ম সইবো না।” কিন্তু তা আর বলতে হলো না।আরশান অন্তির চোখে চোখ রেখে বললো,-আমি জানতাম তুমি নুনের মুখে আমার অসুস্থতার কথা শুনলে ঠিক চলে আসবে।আমার জন্য। আমাকে দেখতে।আরশানের কথায় অন্তি ভ্রু নাচালো। কপালের উপর পড়ে থাকা চুল গুলো কানে গুজতে গুজতে বললো-আমি কি ধরে নিবো? এটা তোমার আত্মবিশ্বাস নাকি অহংকার?-তোমার যেটা ভেবে ভালো লাগে। তবে আমি তো বলবো ভালোবাসা। অন্তি আর কথা বাড়ালো না। এই ছেলের সাথে কথা বলে পাড়বে না ও।আরশান চুলগুলে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বললো-অন্তি দেখো তো জ্বর কেমন?-অন্তি ব্যাগটা ছোফায় রেখে উঠে এসে আরশানের কপালে হাত ছুঁয়ালো।তাপমাত্রা খুব বেশি নেই তবে ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি দূর্বল।আরশান টিশার্ট খুলে ছুড়ে ফেলে অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো-নাও এবার পতি সেবায় লেগে পড়ো তো। আমার শরীর টা একটা নরম কাপড় ভিজিয়ে মুছে দাও। অসস্থি লাগছে খুব।অারশান নুনকে ডেকে এনে একটা কাপড় ভিজিয়ে দিয়ে খাবারের ব্যাবস্থা করতে বললো।অন্তিকে তখন থেকে ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরশান অন্তির হাত ধরে পাশে বসালো। অন্তির কপালের দু পাশে যেখান থেকে চুলের শুরু সেখানটায় পানি চিকচিক করছে। ঘরের তাপমাত্রা আরশানের কাছে তো ঠিকই লাগছে তবুও কেনো মেয়েটা এভাবে ঘামছে কে জানে। অন্তির মুখটা টেনে ধরতেই আরশানের চোখ কেপে উঠলো। মেয়েটা কাঁদছে। কিন্তু কেনো?অন্তি আর নিজেকে আরাল করলো না বরং আরশানের চোখে চোখ রেখে চশমাটা খুলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।-শান আমি তোমায় ভালোবাসি এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ওভাবে তোমাকে গ্রহন করতে পারছি না। চাইলেই তোমার সামনে ছুটে আসতে পারছিনা। আমি চাচ্ছি সম্পর্কটা সুন্দর হোক। কিন্তু কিছু একটা বাধা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আমার বাবা মাকে ঠকাচ্ছি। আমি আমার অনুভূতিটা বোঝাতে পারছি না। আমি কি করবো? তোমাকে পাওয়ার সুখ যেমন আমাকে ভাসাচ্ছে, তেমনি একটা অপরাধবোধ আমাকে গুটিয়ে দিচ্ছে। আমি কি করবো শান?আরশান অন্তির কথাটা মুগ্ধ হয়ে শুনলো। মেয়েটা সত্যি বড় হয়ে গেছে। সবার কথাই ভাবতে শিখেছে।অন্তির হাতটা নিজের হাতে জড়িয়ে নিয়ে আরশান বললো-আমায় ভরসা করো অন্তি, ঠিক করে দিবো সব। একটু সময় লাগবে শুধু। অন্তি শূন্য দৃষ্টিতে আরশানের দিকে তাকিয়ে থাকলো আরশান অন্তিকে কিছুটা স্বাভাবিক করতে বললো -এই যে বউ আর কতোক্ষন নেংটুপুটু হয়ে থাকবো। লজ্জা লাগছে তো। তারাতাড়ি শরীর মুছে দাও।অন্তি হেসে ফেললো আরশানের কথায়।পিঠ মুছতে মুছতে বললো-নুন অনেক ছোট ওকে দিয়ে এসব না করালে হয় না।আমার বিব্রত লাগে।-ও আর আমি খুব ক্লোজ। আমি জানি আমার সিক্রেট গুলো ও খুব যত্নে রাখবে। আর আমাকেও ও সব শেয়ার করে। এই যেমন ধরো ওকে একটা ছেলে খুব পচ্ছন্দ করে। এবার মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। এই ঘটনাটাও ও অনায়াসে আমাকে বলেছে। মজার ব্যাপার কি জানো। নুন নিজেও ছেলেটাকে পচ্ছন্দ করে কিন্তু প্রকাশ করে না। ওর ইচ্ছা হলো ছেলেটাকে অনেক ঘুরাবে। ধৈর্য দেখবে। মেয়েরা তারাতারি রাজি হয়ে গেলে নাকি দাম থাকে না। তাই ছেলেটাকে আরও অপেক্ষা করাবে ও।অন্তি হেসে দিয়ে বললো-আমি কি তাহলে অনেক তারাতারি করে ফেললাম?-মেডাম চারটা বছর কি কম মনে হয়? আরও অপেক্ষা করাতে চাও?-কি জানি?আরশানের খুব ইচ্ছে করছে অন্তিকে জাপটে ধরে বলতে, “হেয়ালি করবে না অন্তি। রানী হয়ে মাথা কিনে নাও নি। রাজাকে সব সময় সঙ্গ দেয়া তোমার কাজ। তুমি কিনা চিন্তা দিচ্ছো।”কিন্তু বলতে পারলো না কিছু। চুলের মাঝে অন্তির বিলি কাটায় কেমন যেনো আবেশে চোখ বুজে আসছে।সকালে হাঁটতে বের হতেই বিহনের সাথে দেখা হয়ে গেলো অন্তির। বেশ কয়েক মাস পর এই লোকটাকে দেখলো। সারাদিন কোথায় থাকে কে জানে? তবে আজ অন্তি কিছু পরিবর্তন দেখলো।আগের মতো এলোমেলো চুল নেই। চোখ গুলোও বেশ কোমল দেখাচ্ছে। এতো সকালে কোথা থেকে বাসায় আসছে লোকটা? ভাবনাটা মাথায় আসতেই তড়িৎ গতিতে ঝেড়ে ফেলে রুশ্যকে নিয়ে হাঁটতে চলে গেলো। বিহনকে দেখে যেনো মেয়েটার বিন্দু মাত্র ব্রুক্ষেপ নাই।আজ মঙ্গলবার বার ক্লাস না থাকলেও অন্তি আর প্রিয়া গেলো এক বান্ধবির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। অন্তির এসব অনুষ্ঠান যদিও ভালো লাগে না। আর বাসা থেকেও এলাও করে না। তবে কাল প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় আর ক্লাস অফ থাকায় আজ অন্তির মা নিজে আগ্রহ করে প্রিয়ার সাথে পাঠালেন। ইউনিভার্সিটির নতুন বান্ধবী।
সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা যেমন জরুরি তেমনি অন্তি আজকাল অনেক চটপটে আর স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ওর এখন আর ঘরকুনো হয়ে থাকাটা শোভা পায় না। আর পরীক্ষার কয়েকদিন এতো এতো পড়ালেখা করেছে যে তাই মিসেস হাসনাত নিজেই চাচ্ছিলেন মেয়েটা একটু এদিক সেদিক ঘুরে আসুক।দুপুরের টগবগে রোদটা হালকা তাপ কমিয়ে এনেছে সবে। অন্তি,প্রিয়া,মিহি,মাধুর্য সবাই মিলে বেশ আড্ডা দিচ্ছে। এরা চারজন এখন খুব ভালো বান্ধবী হয়ে উঠেছে। আজ মাধুর্যরই জন্মদিন। অন্তি ভেবেছিলো হয়তো আরও অনেকে আসবে। তবে যখন দেখলো ওরা চারজন মাত্র। অন্তির বেশ ভালো লাগছে।চকলেট কেকটার উপর সুন্দর করে লেখা”শুভ জন্মদিন আমার আদরের মাধুর্য।”আর বক্স এর উপর ছোট্ট একটা চিরকুট দেয়া”মাধুর্য তুমি আমার জীবনের সবথেকে সুন্দর উপহার। আমি চাই তুমি তোমার জীবনের একটি করে বছর পেড়িয়ে যাওয়ার আগেই পরবর্তী বছরের জন্য এমন কিছু করে যাও যা তোমাকে নতুন বছর জুড়ে খুশিতে ঘিরে রাখে। সবার জন্য কিছু করো। অথবা পথ শিশুদের জন্য এমনি কি চাইলে পথ দৌড়ে হাপিয়ে যাওয়া একটা কুকুরকে পানি ও খাওয়াতে পারো। এটা খুব আনন্দের যে তুমি অন্য কারো মুখে হাসি ফোঁটালে।আর আমি তোমার মুখে সেই আত্নতৃপ্তির হাসি দেখতে চাই।”বিষয়টা অন্তির খুব ভালে লাগলো। কতোটা আদর করে লেখা কথাটা। কেকটা যেহেতু কেউ একজন মাধুর্যের জন্মদিনে উপহার দিয়েছে। আর কথাটা এতো সুন্দর করে লেখা। লোকটা নিশ্চয় অনেক কাছের কেউ হবে। ভাবতেই অন্তির আগ্রহ বেড়ে গেলো।শেষমেশ প্রিয়া আর মিহির খোঁচা খুঁচি তে মাধুর্য বললো -কেকটা তার বড় ভাই উপহার দিয়েছে।এতোদিন জাপান ছিলো। তিনদিন আগে দেশে এসেছে।প্রিয়া আর মিহি না দেখেই যেনো মাধুর্যের ভাইয়ের উপর হোঁচট খেলো। এতো পড়ালেখা জানা ছেলে কিনা নিজের বোনকে এভাবে কতো সুন্দর সুন্দর কথায় উইশ করছে। প্রিয়ার তো জানাই ছিলোনা যারা বই নিয়ে পড়ে থাকে তারা বই এর বাইরের জগৎ নিয়েও ভাবে।মিহি খুব বেশি আগ্রহ দেখাতেই মাধুর্য বলতে শুরু করলো তার ভাই সম্পর্কে, “অরুন আহসান।” পাগলাটে স্বভাবের একটা ছেলে। ব্লা ব্লা ব্লা।হঠাৎই অন্তির চোখ বিশেষ কারো উপর আটকে গেছে। ওদের কারো কথা যেনো এখন আর কানে ঢুকছে না। সৃজনী হায়াত। মানে সৃজা তার দুই টেবিল সামনেই একটা অপরিচিত ছেলের সাথে বসে আছে। খুব ঝগড়া হচ্ছে দেখেই বোঝাযাচ্ছে। সৃজা খুব অস্থির হয়ে হাত মুখ নাড়ছে।অন্তি চশমাটা খুলে কিছুক্ষন বসে থেকে আবার চশমা পড়লো।সৃজা মেয়েটাকে অন্তির খুব ভালো লাগে। সরু নাকের ডগায় একটা তিল আছে মেয়েটার। নৌকার মতো বাকানো ঠোঁট। চোখ গুলো টানা টানা না হলেও কাজল পড়লে বেশ লাগে। অন্তি আর কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর চোখ নামিয়ে প্রিয়ার কাছ থেকে ফোনটা চেয়ে নিয়ে উঠে একটু দূরে যেয়ে আরশানকে কল করলো। যেহেতু আরশানের কথা এখন প্রিয়া ছাড়া আপাদত আর কেউ জানে না ওর বান্ধবিদের মাঝে।সেদিন অন্তি আরশানদের বাসা থেকে আসার পর হাতে গোনা কয়েক দিন অন্তির সাথে ওর দেখা হয়েছে। তা অবশ্য অন্তির বেঁধে দেয়া সময়েই। রোজ রোজ না হলেও বুধবার করে ক্লাস শেষে অন্তির সাথে একই বাসে যাতায়াত। এটুকুই।আরশান খেয়াল করছে মেয়েটা কিছুই বলছে না বরং তখন থেকে হাত মোচড়ামুচড়ি করে যাচ্ছে।চেহারাতেও খুব চিন্তার ভাজ। আরশান নিজেই বললো-হঠাৎ ডাকলে যে।অন্তি কোনো জবাবই দিলো না।আরশানেরও আজ মনটা ভালো নেই। ভেবেছিলো ফাইনাল সেমিস্টারে সিজিপিএ ৪ আসবে। কিন্তু ৩.৯০।এর পর থেকে ছেলেটা পুরোই আশাহত। আর আজ একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিলো। কিন্তু সেখানে যেয়েই বুঝলো আগে থেকেই চাকরির পদ টা কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আরশানের নিজের জন্য সে মুহূর্তে খারাপ লাগে নি। ওর এখন চাকরি না হলেও পরিবারের সাপোর্ট আছে। কিন্তু সেখানে আরও অনেকে ছিলো যাদের মেধা আছে চাকরিটাও দরকার। কিন্তু বর্তমান ব্যাবস্থা ওদের ভাগ্যের বিপক্ষে। সেই রাগটা অবশ্য বাড়ির সবার সাথে ঝেড়ে ফেলেছে। কিন্তু অন্তির এই চুপকরে হেয়ালি ভাব করাটা আরশানকে আরও বিরক্ত করছে।অন্তিকে চুপ থাকতে দেখে আরশান আবার বললো-তুমি নিজেই কিন্তু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলে অন্তি। হুটহাট দেখা করা যাবে না। দুজনের জন্যই ক্ষতিকর। এই যে একই শহরে আছি দুজন। চাইলেই আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারি। সকাল বিকাল সন্ধ্যা তোমার চলার পথে পাশাপাশি হাঁটতে পারি। কিন্তু আমি নিজেও ভেবে দেখেছি এসব করার বয়সটা আর নেই। তোমাকে পেতে গেলে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।অন্তির কাছে আজ আরশানের গলাটা খুব কাঠ কাঠ লাগছে। আবার মনে মনে খুব খরাপও লাগছে। সৃজার কথাটা কিভাবে বলবে। আর বললেও আরশান কিভাবে নেবে কথাটা। তাছাড়া অন্তি এটাও জানে না ওই ছেলের সাথে সৃজার কি সম্পর্ক।অন্তির যেনো নিজের উপরই নিজের রাগ উঠে যাচ্ছে। কেনো যে সব কিছু হুট হাট করতে যায়। কিছু করার আগে ঠিক মতে ভাবেও না। এখন কিভাবে কি বলবে ভাবতেও নিজেকে ছোটলোক মনে হচ্ছে।আরশানের এবার যেনো আরও রাগ উঠে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললো-অন্তি সিরিয়াস কিছু? তুমি কি কিছু নিয়ে ভাবছো?অন্তি এবার কপাকাপা গলায় জবাব দিলো-সৃজা আপু। উনাকে দেখেছি একটু আগে।-হ্যা। তো কি হয়েছে? ও কি কিছু বলেছে?-না।-তাহলে?-আসলে উনার সাথে একটা ছেলে বসে ছিলো।
তারপর অন্তি সব বললো। তখন ওদের দেখে মনে হয়েছিলো ওরা ঝগড়া করছে। তাই অন্তি সে বিষয়টাও বললো।আরশান বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে অন্তির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। আরশান এতোদিন চায়নি সৃজাকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠুক। কিন্তু এখন সে এই প্রশ্নেরই মুখোমুখি। অন্তি মাথা নিচু করে বসে থাকলেও আরশান সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত লেকটাকে দেখছে। বিকালের মৃদু বাতাস। লেকের পাড়ের মিষ্টি পরিবেশটাও বিধঘুটে লাগছে।আরশান বলতে শুরু করলো-অন্তি যা বলবো, যা বোঝাতে চাইবো একটু মন দিয়ে শুনো।-হুম।-সৃজা আমার কাজিন। একদম কাছের না আবার দূরেরও না। ও আমার থেকে তিন সাড়ে তিন বছরের ছোট।অন্তি আরশানের মুখের দিকে তাকালো। খুব অসহায় লাগছে চেহারাটা। কিন্তু এসব কেনো অন্তিকে বলছে কারন টা অন্তি বুঝলো না।-সৃজার যখন পাঁচ কি ছয় বছর তখন হঠাৎ ওর মা বুঝলো ওর বাবা পর নারীতে আসক্ত।স্বভাবতই সৃজার মা তা মানতে পারলেন না। দিনকে দিন বিষয়টা খারাপ হচ্ছিলো। উনাদের সেপারেশন হয়ে গেলো। আন্টিও একটু একটু করে কেমন জানি হয়ে গেলেন। যদিও এসব কিছুই আমার মনে নেই। মার মুখে শুনেছি।-তারপর? (অন্তির আগ্রহটা বেড়ে গেলো এবার)-তারপর ডক্টর নিশ্চিত করলেন যে আন্টি টোটালি মানসিক রোগী। সৃজা ক্লাস ফাইভ এ উঠলো। তখন অবশ্য ওরা ওর নানু বাড়িতেই থাকতে শুরু করেছে। হঠাৎ একদিন আন্টি আত্নহত্যা করে ফেললেন।অন্তি নির্বাক হয়ে কথা গুলো শুনছে।-মেয়েটার জীবনে মজা করে হেসে খেলে কাটানোর সময়টাই একদম বাজে ভাবে কাটলো। সৃজার কপালে একটা কাটা দাগ আছে। দাগটা সবার চোখে বাজলেও আমার কেনো যেনো খুব ভালো লাগে দাগটা। কেননা এটা ওর মার দেয়া একটা চিহ্ন। আন্টি বেঁচে থাকতে সৃজাকে কখনও কাছে ঘেসতে দিতেন না। হয়তো আন্টি না বুঝেই আঘাত করে দাগ টা করেছিলেন।অদ্ভুদ বিষয় কি জানো তার বাবা আর কোনোদিন ওর খোঁজ নেয় নি। কতোটা অমানুষ। নিজের সন্তানের কথাও ভাবলেন না কোনোদিন। বেঁচে আছে নাকি নেই।এই সবকিছুর পরও মেয়েটা সুখ দেখলো তার মা মারা যাওয়ার পর। একটা সস্থির জীবন। পড়ালেখায় খুব ভালো করতে লাগলো। আমার পরিবারের সাথেও ওর মামাদের সম্পর্ক অনেক ভালো। সেই হিসেবে ওকে ছোট থেকেই আমি চিনি। কখনও ওর জীবনের গল্প শুনে আমার দয়া হয়নি। তবে কেমন জানি অনেক মায়া হতো। এখনো হয়।অন্তির খুব কান্না পাচ্ছে। দু এক ফুটা চোখ থেকে গড়িয়েও পড়েছে। আরশানের হাতের মুঠোটা আরও শক্ত করে অন্তি ধরলো। সৃজাকে দেখে অন্তি কখনও বুঝেই নি মেয়েটা এতো কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছে।আরশান কিছুক্ষন থেমে আবার বললো-অন্তি তুমি হয়তো ভাবছো এতো সব বলছি কেনো?আমি আমার জীবনে সৃজার অবস্থানটা তোমার কাছে ক্লিয়ার করতে চাইছি তাই এসব বলছি।সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো। ওই মেয়ের মাঝে আমি কোনেদিনও আমার জন্য বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোনো কিছু দেখি নি। তুমি চলে গেলে। সৃজাও বড় হলো। আমার পরিবার আর ওর পরিবার একটা সহজ সমাধান করলো যে ওকে আমি বিয়ে করবো। ওর জন্য একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ যেমন ওর মামারা খুঁজছিলো তেমনি আমার পরিবার আমাকে নতুন করে গড়ার জন্য এমন একটা মিষ্টি মেয়েকে হাতছাড়া করতে চাইলো না। বিষটা এমন হলো যে তোমার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে ওকে আমার সাথে জড়িয়ে দিলো।এই সব কিছুও যখন দুজনে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম সে সময় সৃজার জীবনে “আহির” আসলো। কিভাবে কিভাবে যেনো সৃজা ওকে ভালোবেসে ফেললো। তবে তা দূর থেকেই,একপাক্ষিক।সবথেকে বড় টুইস্ট কি জানো?ওই ছেলে কথাও বলতে পারে না কানেও শুনে না।অন্তি সমস্ত শরীরটা ঝাকুনি দিয়ে উঠলো।আরশান আবার বললো-সৃজার জীবনে আবার দোটানা শুরু হলো। আমাকে অথবা আহিরকে বেছে নিতে পারছিলো না। একবার পরিবারের চাপে আমার দিকে ঝুকে তো মনের চাপে আহিরের দিকে। আর সৃজা যেদিন থেকে বুঝতে পারলো আহিরও ওকে ভালোবাসে সেদিন থেকে ওর জীবনটা কেমন যেনো হয়ে গেলো।অন্তি আমি ওকে অনেক হাসতে দেখেছি কিন্তু প্রাণ ছাড়া। ও নিজে জানায় নি আমাকে কিছু। কিন্তু আমি যে জানি ও কেমন করে যেনো বুঝে গেলো। এর পর থেকে আমাদের মাঝে যেনো অঘোষিত চুক্তি হয়ে গেলো।ও সবাইকে এটা বোঝাতে শুরু করলো ও আমাকে চায়। বিশেষ করে আমার পরিবারের সামনে। আমাকেও বোঝাতে চেষ্টা করে গেলো। তোমার মতও হওয়ার চেষ্টা করলো বেশ কিছুদিন। আর আমার সেসময় দায়িত্ব হলো ওকে ইগনোর করা। কেননা এখানে সবথেকে মজার বিষয় হলো আমি রাজি না হওয়া পর্যন্ত কিচ্ছু হবে না।যদিও আমি ওকে কখনও বন্ধুর বেশি ভাবি নি।আমি সবসময় চেয়েছি ও এই দোটানা থেকে বেড়িয়ে আসুক। যেকোনো একটা বেছে নিক। আহির ওকে ভালোবাসে। কিন্তু সামনের জীবনটা তো অনিশ্চিত। যদিও আমার কাছে মনে হয়না। আহির পড়ালেখা জানা ছেলে। ওর এই অক্ষমতা কিন্তু ওর জীবনে প্রতিবন্ধকতা হয় নি।আহিরের পরিবার অনেক নাম করা। তবুও সৃজাকে এমন ছেলের হাতে ওর মামারা দিবে না। আর তুমি আমার জীবনে আবার যখন ফিরলে আমি চাই ও ওর জীবনটা গুছিয়ে নেক। আমার জীবনে ওর কোনো অস্তিত্ব রাখতে চাইনা আর।অন্তি তোমার কাছে কি সৃজাকে খুব এলোমেলো লাগছে?প্রশ্নটায় অন্তি হ্যা না কিছুই বললো না। সত্যি সৃজাকে ওর কেমন যেনো লাগছে। মেয়েটা দুই নৌকায় পা রাখছে না তো? নাকি সৃজার জীবনের গল্পটাই এমন।সব কিছু পেতে পেতেও হাড়িয়ে ফেলে।হঠাৎ নিজেকেও এসবের মাঝে কানেক্ট করছে অন্তি। আচ্ছা অন্তি না ফিরলে কি সৃজার জীবনটা আরশান গুছিয়ে দিতো? হয়তো বা!আরশান অন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-ধরো এর মাঝে তোমার জীবনে অন্য ছেলে এসেছে অথবা ধরো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে এই কয়েক বছরের মাঝে। তুমি কি আমায় ভুলে যেতে? একদমই ভুলতে না অন্তি। কিন্তু মনেও রাখতে না। তোমার মনের কোথাও আমি থাকতাম তবে সেটা দেখার সুযোগ তোমার হতো না। কেননা তোমার তখন নতুন কাউকে নিয়ে না চাইলেও ভাবতে হতো।সৃজা যথেষ্ট মেচিউরড। ও মেবি এটাকেই সমাধান ভেবেছিলো। আমি চাই না তুমি ওকে ভুল বুঝো। তাই তোমাকে সহয করে বোঝাতে চাইলাম।
আমার এতো কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য তুমি ওকে যেনে পুরোটাই বুঝতে পারো। ওর বাধ্যবাধকতা গুলো জানতে পার।তবে আমি চাই ও খুব করে যুদ্ধ করুক। সব কিছুর বিরুদ্ধে যেয়ে ও আহিরকে নিজের করে নিক। ওর দু-টানা ভাবটা কেটে উঠুক।অন্তি এতোক্ষনে কাপা গলায় জবাব দিলো-আচ্ছা আমি কি সৃজা আপুকে আবার এলোমেলো করলাম? আমার ফিরে আসাটা কি অনুচিত হয়ে গেলো?আরশান কোনো উত্তর দিলো না। কেনো জানি ইচ্ছে করলো না। শুধু চলে যাওয়ার আগে অন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-তোমার আসার ছিলো অন্তি। তোমার আসাটা আমাদের দুজনের জন্য জরুরি ছিলো।বলতে পারো আমাদের অসমাপ্ত সম্পর্ককে পূর্ণতা দেয়ার জন্য।বিকালের ঘুমটা ভেঙ্গে যেতেই অন্তি বসার ঘরে ঢুকেই দাড়িয়ে পড়লো।বিহনের মা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথা বলছেন।অন্তিকে দেখে যেনো একগাল হেসে অন্তিকে ডেকে নিয়ে পাশে বসালেন।তারপর অন্তির মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-বুঝলেন ভাবি আপনার মেয়েটা কিন্তু অনেক লক্ষি।আমার তো ওই এক ছেলে, কোনে মেয়ে নেই।এমন একটা মেয়ে থাকলে আর কি চাই বলুন তো। অন্তির কাছে বেশ বিরক্ত লাগছে তবুও চুপ চাপ মুখে হাসি ফুটিয়ে বসে আছে।মিসেস হাসনাত মিষ্টি হেসে বললেন-আমার মেয়েটা একদম মাটির পুতুল।যেমন রাখি অমনই থাকে।এটুকু বলেই অন্তির গালে হাত বুলিয়ে দিলেন মিসেস হাসনাত।তবে এসুযোগটা যেনো মিসেস চৌধুরি অর্থাৎ বিহনের মা কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করলেন না।ফট করে বলে ফেললেন-ভাবি মেয়েটা আমাকে দিয়ে দিন।আমার বেশ পচ্ছন্দ।নিজের মেয়ে করেই রাখবো।অন্তির মার গলায় যেনো চা আটকে গেলো।অন্তিও হা করে বিহনের মার দিকে তাকালো।এমন কিছু হবে সে কল্পনাও করে নি।বিহনের মা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো-আমার ঘরে একটা যোগ্য ছেলে আছে আর আপনার মেয়েটাও বড় হচ্ছে।হাতের কাছে এমন ভালো মেয়ে থাকতে কেনো শুধু শুধু হাতছাড়া করবো বলেন তো।আমার ছেলেরও কিন্তু আপনার মেয়েকে বেশ পচ্ছন্দ।পাশের রুম থেকে অন্তির বাবা পেপার ভাজ করতে করতে বসার রুমে ঢুকে অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন-অন্তি তোমার রুমে যাও।আমরা বড়রা কিছু কথা বলি।এই একটা কথাই যেনো অন্তির বুকে ভয় সৃষ্টি করলো।কি বলবে ওর বাবা???বিহনকে কি ওদের পচ্ছন্দ????আরশান!!! আরশানকে ছাড়া তো অন্তি আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না।তাহলে এখন কি সবার সামনে এই ব্যাপারে না করে দিবে।এসব ভাবতে ভাবতেই এলো মেলো পায়ে নিজের রুমে ঢুকে পর্দা টেনে দরজা চাপিয়ে রাখলো।পুরো দরজা ব্ন্ধ করলো না অন্তি।বুকের ভেতর কেমন জানি ভয় করছে।অন্তি কোনোদিনও আড়ি পেতে কারও কথা শুনে নি।তবে আজ এছাড়া উপায়ও নেই।কি হচ্ছে তা জানাটা খুব জরুরি।কান পেতে শুনতে লাগলো।যদিও মিসেস চৌধুরি কি বলছেন তা স্পষ্ট শোনা না গেলেও অন্তির বাবার গলাটা অন্তি স্পষ্টই শুনছে।অন্তির বাবা খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ।কথাও খুব গুছিয়ে বলতে পারেন।মিসেস চৌধুরির উদ্দেশ্যে বললেন-আপা আপনি একটা প্রস্তাব রেখেছেন।আমরা অবশ্যই তার সম্মান করি।কিন্তু আমার মেয়েটা অনেক ছোট।সবে ইউনিভার্সিটি তে পা রাখলো।একটা বছরও যায়নি।এখনই বিয়ে দিবো না আমরা।মিসেস চৌধুরি বললেন-এখনই কেনো বিয়ে দিতে হবে।ওরা এযুগের ছেলে মেয়ে কথা বলুক।ওদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং আসুক।আমরা তো বিয়েটা পড়েও দিতে পারবো।অন্তির মা কিছু বলতে গেলে অন্তির বাবা তাকে থামিয়ে আবার বললেন-আপা আমরা এসব এখনই ভাবছি না-আপনার মেয়েকে আমাদের সবার বেশ পচ্ছন্দ।আমার ছেলেটাতো অন্তিকে দেখার পর থেকেই আমাকে বলছে।নিজেকে যোগ্য করারও চেষ্টা করছে।অন্তির বাবা এবার মুখটা আর একটু শক্ত করে বললেন-ও কি সব বাজে অভ্যাসও ছেড়ে দিয়েছে???আমি জানি আপা আপনার শুনতে খারাপ লাগবে।তবুও এটা আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রশ্ন।আমি বলতে চাচ্ছিলাম না এসব তবুও বলতে হচ্ছে,এ বাড়িতে আমি যখন ভাড়া নিলাম হঠাৎ একদিন ছাদে একজনকে গাঁজা খেতে দেখেছি।ছেলেটা কিন্তু বিহন ছিলো।মিসেস চৌধুরির যেনো বুকের মাঝে ধক করে উঠলো।কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।কিছু বলতে যাবোন তার আগেই অন্তির বাবা আবার বললেন-আমার সে মুহূর্তে মনে হয়েছিলো ভুল বাসায় ভাড়া নিয়ে ফেলেছি।আমার ছেলেমেয়ে গুলো ছোট ওদের উপর এসব আবার প্রভাব না ফেলে।আবার মনে হলো এতো বড় বাড়িতে এসব কিছু একটু আধটু হয়তো হয়।আমার সন্তান রা এসবে জড়াতে যাবে না।ওদের ছাদে যেতে বারন করে দিলাম।তবুও হয়তো অন্তি দু একবার গেছে।মেয়েটা আমার খোলামেলা যায়গা পচ্ছন্দ করে তাই ওকে সেভাবে বাধা দেই নি।এখন মনে হচ্ছে বাঁধা দেয়া উচিৎ ছিলো।আর আমি নিজে বিহন সম্পর্কে খোজ নিলাম।সম্ভবত ওর ইউনিভার্সিটির একটা ঝামেলায় জড়িয়ে ও দু বছরের জন্য বহিস্কৃত হয়েছিল।তারপর থেকে এমন নেশা করে অথবা বলতে গেলে বাজে অভ্যাস গুলো তে জড়িয়ে গেছে।তবে একটা বিষয় আমাকে স্বস্থি দিয়েছিলো যে ওই ছেলের মেয়েদের ব্যাপারে কোনো বাজে রেকর্ড নেই।তাই অন্তিকে নিয়ে আমি এই বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবি নি।কিন্তু আজ যখন প্রস্তাব আসছে এখন এটাও মনে হচ্ছে ভাবা দরকার ছিলো।মিসেস চৌধুরি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো-আমার ছেলেটা শুধরে গেছে ভাই।অন্তিকে পেলে ও একদম ভালো হয়ে যাবে।সব ছেড়ে দিবে।আর আমাদের আল্লাহর রহমতে অনেক সম্পতি।ঢাকা শহরে এমন আরও তিনটা বাড়ি আছে।অনেক জমি জমা আছে।আর এই সব কিছুর উত্তরাধিকারী বিহন চৌধুরি।আর বিহনের সব কিছু তো অন্তিরই হবে।অনেক আয়েশে জীবন কাটাতে পারবে।অন্তির বাবা একটু হেসে বললেন-আপা আপনার মতো শ্বাশুড়ি আর মিস্টার চৌধুরীর মতো শ্বশুর পাওয়া যে কোনো মেয়ের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।কিন্তু যার সাথে সম্পর্কে জড়াবে তার উপরই আমার ভরসা নেই।বিহনের সম্পত্তি অবশ্যই আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অত্যন্ত লোভনীয়। কিন্তু আমার মেয়ের জীবনটা আমি লোভে পড়ে অনিশ্চিত করে দিতে পারবো না।আমার হয়তো অঢেল টাকা পয়সা নেই তবে আমার সন্তান দুটো আমার কাছে সব থেকে বড় সম্পদ।ওদের জীবনের নিশ্চয়তা আমার কাছে সব কিছুর উর্ধ্বে।-ভাই আমি আমার ছেলের সুখটাও তো ভাবছি।আমি জানি আপনার মেয়ে আমার ছেলেটাকে একদম শুধরে দিবে।-আপনি নিজে তো জানেন আপনার ছেলের ফল্ট গুলো।অন্তি আপনার মেয়ে হলে আপনি কি আপনার মেয়েকে এমন ছেলের হাতে দিতেন????আপা আমার মেয়েটা কখনও নিজের জন্য কিছু চায় নি।খুব সাদামাটা একটা মেয়ে।সবসময় আমাদের ইচ্ছা ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছি ও মুখ বুজে সহ্য করেছে।এবার ও মুখ ফুটে বলেছে ও পড়ালেখা করতে চায়।খুব নাম করতে চায়।প্রথম সেমিস্টারেও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে।আমি ওর স্বপ্নটা শেষ করতে চাই না।ও ওর জন্য কখনও কিছু চাইতে পারে না।নিজের হয়ে কিছুর প্রতিবাদও করতে পারে না।ওর আবদার অনেক কম।আমি এটা পূরন করতে চাই আপা।এই কথাটার পড় মিসেস চৌধুরি আর একটাও কথা বললেন না।চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।অন্তির এই মূহুর্তে পুরো পৃথিবী আবার রঙ্গিন লাগছে।খুব নাচতে মন চাচ্ছে ওর।ইশ হুট করেই সব কিছু সুন্দর লাগে কেনো??ওর বাবাকে ও ঠিক বুঝে না।আচ্ছা অন্তি কি সবসময় ওর বাবা মা কে ভয় পেয়ে ভুল বুঝে দূরে থেকেছে???কখনও কি নিজে থেকে বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করেছে??নাহ অন্তি তো এটা কখনই করে নি।পিহুকে কোলে নিয়ে মনে মনে ভাবলো -বাবা মা তো এখনো পর্যন্ত আমার জন্য খারাপ কিছু করে নি।শাসন হয়তো বেশি করে।কিন্তু আমি যেনো ভুল না করি সেই জন্য।আর এই শাসন কে বড় করে দেখেই কি আমি তাদের থেকে দূরে সরে এসেছি????অন্তির বাবার আর একটা কথা তার খুব ভালো লেগেছে।ও আর রুশ্য ওর বাবার সম্পদ।অন্তি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো ও সত্যিকারের সম্পদ হয়ে দেখাবে।জীবনে অনেক বড় হবে ও।রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়াটা অন্তির কেমন যেনো লাগে।চারপাশে কত কত মানুষ।এতো মানুষের মাঝে অন্তির খুব নার্ভাস লাগে।অনেক কাজিন বন্ধু বান্ধব অথবা ফ্যামিলির সবাই থাকলেও এতোটা নার্ভাস লাগে না।কিন্তু কাপলদের মতো বসে থাকাটা খুব অস্বস্তিকর। পরিচিত কেউ দেখে ফেললে খুব বড় ঝামেলা হয়ে যাবে।অন্তি দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বললো-শান আমার পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে??আরশান হেসে দিয়ে বললো-তুমি তো জিমে করেছো অনেক দিন।নাক বরাবর বসিয়ে দিবে।শক্তি পরিক্ষা করাও হয়ে গেলো।বেচারা ভয়ে বলবেও না।-সব কিছু নিয়েই মজা করো কেনো??-ধরা না পড়লে প্রেমে মজা নেই অন্তি।-খুব মজা তাইনা??ধরা পড়লে কি হয় এখনো শিক্ষা হয়নি???আরশান অন্তির হাত ধরে বললো-এবার কিছু হলে তুলে এনে বিয়ে করবো অন্তি।তোমাকে হাড়িয়ে যেতে দিবো না।তবে আমার মনে হয় তোমার এখন একটা ফোন ব্যাবহার করা উচিৎ।প্রিয়ার ফোন তো সবসময় তোমার কাছে থাকে না। কখন কি হয় তা তৎক্ষনাৎ আমাকে জানানোর জন্য।তাছাড়া কখন কোন বিপদে পড়।বাসার যোগাযোগ করার জন্য হলেও।অন্তি আর কিছু বললো না।আরাশনের সাথে যতোক্ষন থাকে প্রতিটা মুহূর্ত অনেক সুন্দর হয়ে যায়।আরশান যখন অন্তির চুল গুলো তে হাত বুলায় অন্তির কতোটা খুশি লাগে তা অন্তি বলে বুঝাতে পারবে না কাউকে।যখন আরশান অন্তির গাল টেনে দেয় আর তার পর গাল লাল হয়ে গেলে কানে ধরে সরি বলে এই দৃশ্যটাও অন্তিকে মুগ্ধতা দেয়।আজ আরশান বলছিলো-অন্তি তুমি প্রেমিকা টাইপ নও তুমি হলে পাক্কা সংসারী টাইপ মেয়ে।অন্তি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো-মানে???-এই যে,প্রেমিকাদের এতোএতো আবদার থাকবে।এটা চাইবে ওটা চাইবে।রোমান্স থাকবে।গল্প করবে।ঘুরাঘুরির জন্য অস্থির থাকবে।কিন্তু তুমি?? তোমার সব সময় আমি কি করলাম??খেয়েছি কিনা??সবাই ঠিক আছে তো??ধরা খাবো নাতো??এসব চিন্তাঅন্তি এখন প্রেম করছি প্রেমটাতেই মন দাও। বিয়ের পর কিন্তু এই জীবনটা পাবে না।তখন চাইলেও এই মুহূর্তের মজাটা পাবে না।তখনও আমরা প্রেম করবো তবে এমন টা হবে না।সেসময়ের প্রেমটা আলাদা।তুমি বরং বাদাম খেয়ে পার্কে বসে প্রেম করাটাই এখন মন ভরে উপভোগ করো।অন্তি আরশানকে বললো-আমি কি তোমার শুধুই প্রেমিকা?-নাহ্।আমার বন্ধু, আমার সপ্ন,আমার ভবিষ্যত আর আমার অর্ধাঙ্গিনী।তবে তোমাকে আমি পাগলি ডাকবো।কেননা তুমি নিজে আমাকে দূরে দূরে থাকতে বলো,দেখা করতে না করো,আমাকে শাসন করো,অথচ এই তুমি আমাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাও।এটা কি অনেক বেশি ভালোবাসার পাগলামি????আচ্ছা অন্তি ভালোবাসা কেনো এমন অসহ্যকর সুখের হয়।ছেলেটা কিসুন্দর করে কবিতা বলছিলো আজ””””-পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাবপাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবনএর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদাপাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতেতুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসনপাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাবপাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।””””অন্তি মুখ ভার করে প্রশ্ন করেছিলো-৪২ কেনো???আর বেশি নয় কেনো???রিক্সায় বসে এসব ভাবতেও অন্তির বেশ হাসি পাচ্ছে।আরশান এতো সুন্দর করে কথা কেনো বলে???এই একটা জিনিস অন্তিকে মুগ্ধতায় বন্দি করে দেয়।চলে আসার সময় আরশানকে মন ভরে দেখছিলো অন্তি -গালে ছোট ছোট দাড়ি,রেডিস পিংক ঠোট,কেমন মেয়েলি চোখ আর হাত দিয়ে বার বার একপাশ করে কাটা চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করা প্রতিটা বিষয় অন্তি খেয়াল করেছে।কালো টিশার্টের গলাটা টানতে টানতে বার বার বলছিলো -সাবধানে যাবে কিন্তু। রিক্সায় তুলে দিয়েও বলছিলো-মামা সাবধানে নিও।ইশ এই ছেলেটা অন্তিকে এক জীবন মুগ্ধ করে রাখতে পারে।ভাবতে ভাবতেই বাসার গেটে এসে নামলো অন্তি। লিফটে উঠেই বুকটা কেপে উঠলো অন্তির…বিহন চৌধুরী। খুব যে রেগে আছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।অন্তি লিফট থেকে বেড়িয়ে পড়বে তার আগেই ছেলেটা অন্তির হাত টেনে ভিতরে নিয়ে দরজা বন্ধকরে দিলোঅন্তির ভয়ে কাপা কাপা ঠোঁটের কাছাকাছি মুখ এনে হাতদুটো চেপে ধরে বললো-বাসা ছেড়ে দেওয়ার কি দরকার। আমি কি জোড় করে বিয়ে করছি????দূর থেকেই তো দেখি।সামনে এসে কি বিরক্ত করি???তোমার বাবাকে বলবে বাসা ছাড়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে।আরঅন্তি আর কিছু বলার আগেই কোনমতে হাতটা ছুটিয়ে নাক বরাবর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে একটা ঘুসি দিতেই ব্যাথায় বিহন হাত ছেড়ে দিলোঅন্তিঝটপট ব্যাগ থেকে কাঁচি বেড় কড়ে চোখালো অংশ টুকু দেখিয়ে বললো-আর একপা ও এগোবি না।আমার কাছে ঘেসবি না।বিহন গলা খাকরে বললো-আরশান কাছে ঘেসলে ভালো লাগে তাইনা??আমার না হলে আমি আরশানেরও হতে দিবো না তোমাকে অন্তি।এতো সহজে আমি হেরে যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *